শিক্ষা মন্ত্রণালয় তথা সরকার পাবলিক পরীক্ষা ও ফলাফল পদ্ধতি নিয়ে অনেকদিন থেকে নানাভাবে সমালোচিত হয়ে আসছিল। আনন্দের কথা সম্প্রতি তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে। বিগত বছর দুই ধরে এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলে হঠাত্ বড় পরিবর্তন ঘটতে শুরু হয়েছে। পাসের হার আর অস্বাভাবিক ভালো ফলের বিস্ফোরণ এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে একটি যৌক্তিক জায়গায় চলে আসছে। ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক যারা এতদিন সুবিধাভোগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন— তারা হয়তো কষ্ট পাচ্ছেন—ক্ষুব্ধ হচ্ছেন, তবে আমি জানি বাস্তবতার উঠোনে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে ভাবলে তারাও স্বস্তি পাবেন। আমরা মনে করি, শিক্ষা লাভ ও সার্টিফিকেট মূল্যায়নের পরবর্তী বাস্তবতাগুলোকে যদি জ্ঞানকেন্দ্রিক করা না যায় তবে এই অস্বস্তি কমানো কঠিন হবে।
অতিসম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে আকাশচুম্বি পাসের হার এবং অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জিপিএ-৫ এর ছড়াছড়ি তেমন না থাকায় নানা পক্ষ কষ্ট পেলেও দীর্ঘদিন শিক্ষার সঙ্গে জড়িত থাকা মানুষ হিসেবে আমি অনুভব করছি, আমার মনের ভেতরের পাথরটা সরে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ফিরে আসছে স্বস্তি। মানছি, কয়েক বছর আগেও অনেক অভিভাবক ও শিক্ষার্থী দেখেছেন জানার জগতে যাই থাক, কয়েকজন প্রাইভেট শিক্ষক আর কোচিং সেন্টারের দেওয়া ছক গলধকরণ করে অনায়াসে যে ছেলে-মেয়ে, ভাইবোন জিপিএ-৫ অথবা স্বর্ণখচিত ৫ পেয়ে যেত, এখন একই মেধার আর একই পরিচর্যার উত্তরসূরিরা তেমন ফল লাভ করছে না। ফলে তাদের কষ্ট তো হবেই। এইচএসসির ফল প্রকাশের পর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন আগে অনেক বেশি পাস করতো বলে সমালোচনা শুনতে হয়েছে, এখন পাসের হার কমে যাওয়াতেও সমালোচনা হচ্ছে।
আমি মনে করি এ ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের কোনো অর্থ হয় না। স্কুল-কলেজে যৌক্তিকভাবে পড়ালেখা করানোর দায়িত্ব পালন করবেন শিক্ষকবৃন্দ। অভিভাবক সন্তানের প্রতি উচিতমত পর্যবেক্ষণ রাখবেন। শিক্ষার্থীকে যেভাবে পাঠ্যপুস্তক এবং চারপাশের জ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করবে। নিয়মমাফিক পরীক্ষা হবে। মুক্ত বিবেক নিয়ে, মুক্ত পরিবেশে শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে ফলাফল প্রস্তুত করবেন। যথাসময়ে আপন গতি ও ধারাতেই ফল প্রকাশিত হবে। এখানে শিক্ষামন্ত্রী বা সংশ্লিষ্টদের সমালোচিত হওয়া বা বিব্রত হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অন্যথা হলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে তাহলে কি আগে বিশেষ নির্দেশনায় উচ্চ ফলাফলের জোয়ার বইতো? এখন আবার কৃত্রিম বাঁধ দিয়ে ফলাফলের জোয়ার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে? দুটো ধারাই কিন্তু স্বাভাবিক নয়। সুস্থ মানুষ চাইবে সুস্থ ধারা ফিরে আসুক।
নিকট অতীতের ফলাফল বিস্ফোরণের কথায় আসি। সবকিছুর রাজনীতিকরণ সুস্থ ধারা বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। অবস্থার বাস্তবতায় একে রাজনীতিকরণ না বলে কুরাজনীতিকরণ বলাই শ্রেয়। কে যে আমাদের ক্ষমতাসীন দলগুলোকে বুঝিয়েছিল, বেশিসংখ্যক পাস না করলে আর জিপিএ-৫ না পেলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের কৃতিত্ব প্রকাশ পাবে না। অবশ্য নিজ মেধায় অনেক বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী উজ্জ্বল ফলাফল করলে কোনো বাধা নেই। কিন্তু বলপূর্বক বা কৌশলে মেধাবী বানানোতে রয়েছে সংকট।
অধুনা প্রথম-দ্বিতীয় বিভাগের যুগ নেই। এখন গ্রেডিং পদ্ধতিতে ফলাফল হয়। উর্বর ভাবনা এ পদ্ধতিতেও আছে। ধরি যদি ৭০ ভাগ ‘বি’, ২০ ভাগ ‘এ’ আর ১০ ভাগ ‘বি প্লাস’ পায় তাহলে চলবে না—ফলাফলে বিস্ফোরণ ঘটাতে হবে। ‘এ’ আর ‘এ প্লাসে’ যত সয়লাব করে ফেলা যাবে তত শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর সরকারের কৃতিত্বের আলো ছড়াবে। একারণেই স্কুলের শিক্ষকদের কাছে কৌশলী বার্তা নাজিল হয়, ছাত্র-ছাত্রীরা কষ্ট করে কিছু লিখলেই পরীক্ষকের কলম সচল করতে হবে হাত খুলে নম্বর দিতে। স্কুলগুলোতে শতভাগ পাসের রেকর্ড গড়তে হবে। এভাবেই ‘পাস’, ‘এ’, ‘এ প্লাস’ আর স্বর্ণ মোড়ানো ‘এ প্লাসে’র জোয়ারে মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেধাচর্চার কোনো সুযোগ পাচ্ছিল না। পুরোটা কেড়ে নিয়েছে জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতা। ঘাড়ের ওপর একের পর এক প্রাইভেট টিউটরের নিঃশ্বাস। একের পর এক শিক্ষকের বাড়ি আর কোচিং সেন্টারে ছুটোছুটি। এভাবে ছকে বন্দি হয়ে যায় পড়াশোনা। ছক পূরণ করতে করতে সময় শেষ।
এই ছকবন্দি লেখাপড়ার পরিণতি কেমন আমরা যারা দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি তারা টের পাচ্ছি। মেধা বিস্ফোরণ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাবীদের মুখ থুবড়ে পড়া নিয়ে এবার বেশ বিতর্ক জমেছিল। যারা রাজনীতির বদ্ধ জলাশয়ে ঘোরাফেরা করেন, তারা দায়ী করছেন পরীক্ষা পদ্ধতি ও প্রশ্নপত্রের অন্যায় কড়াকড়ি নিয়ে। অন্যপক্ষ বলতে চাইছেন ‘জিপিএ পাঁচ’ ধরনের ফলাফল প্রমাণ করছে না এসব শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত যতটুকু মেধাচর্চা করে আসার কথা তা করে আসতে পারছে। এর অর্থ এই নয় যে, সকল শিক্ষার্থীর মেধার ঘাটতি বয়েছে। বরঞ্চ এরা যে শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে তাতে সিলেবাসের ছকের বাইরে জানার জগত্ শানিত করার তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে।
গলদ তো একটি আছেই। আমাদের শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ন করছি না, তবে ওদের দুর্ভাগ্য নিয়ে ভাবছি। বছর কয়েক আগেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাচ্ছিল ফলাফলে আলোকোজ্জ্বল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সরকারের কৃতিত্ব সাধারণ্যে প্রকাশ পাক। ভর্তিযুদ্ধে উচ্চ গ্রেড পাওয়ার একটি ভূমিকা আছে, আবার অভিভাবকদের মধ্যে ছেলেমেয়ের ফলাফলের সঙ্গে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার তাড়নাও রয়েছে। তাই শিক্ষার্থী জানার জন্য নিজেকে কতটা শানিত করতে পারলো একে মোটেও বিবেচনায় আনা হচ্ছিল না। ছকবন্দি পদ্ধতিতে ফলাফল কতটা উজ্জ্বল হলো সেটাই বিবেচনায় গুরুত্ব পাচ্ছিল।
এ কারণে এ সকল উজ্জ্বল ফলাফল করা ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক ছেঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার পর দেখা যায় তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম অল্প কিছুসংখ্যক বাদ দিলে অধিকাংশের পুঁথিগত বিদ্যার বাইরে জানার সঞ্চয় খুবই কম। গুণগত দিক থেকে এদের অধিকাংশ মেধাবী এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ভুল পদ্ধতিতে ‘এ,’ ‘এ প্লাসে’র প্রতিযোগিতায় ছিল বলে যৌক্তিকভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারেনি। তাই এই শূন্যতা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাকে প্রচণ্ডভাবে তাড়িয়ে বেড়ায়। জাতিও সামগ্রিক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, দুই দশক আগেও যেসব ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেতো তাদের ভিত্তিটি অনেক বেশি সবল ছিল। এটি আমি সাধারণীকরণ করে বলছি। অন্তত প্রথমবর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ইংরেজি-বাংলা উভয় ক্ষেত্রে ভাষা ও বানান জ্ঞান অনেক ভালো ছিল। এখন তো সদ্য ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বড় অংশের অনুশীলনী পরীক্ষায় বাংলা বানানের ভুল কাটতে কাটতে পৃষ্ঠা লাল হয়ে যায়। তখন ভাবতে হয় এই অবস্থা নিয়ে এই ছাত্র বা ছাত্রীটি স্কুল বা কলেজের গণ্ডি পেরুল কেমন করে!
এই ছোট দেশটিতে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টরা যতই অস্বীকার করুন স্কুল কলেজের শিক্ষকরা আমাদেরই ছেলে-মেয়ে, ভাইবোন। তাই সত্য জানা খুব কঠিন নয়। কিছুদিন আগেও অসুস্থতা ছিল। উপরের আদেশেই হাত খুলে নম্বর দিয়ে দিয়ে ফলাফল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এভাবে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অন্যায় প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন বাস্তবতার কাছে আত্মসমর্পণ করে রাশটানা হয়েছে। এই রাশটানাটিও যদি অস্বাভাবিক হয় তবে তাও হবে আরেকটি অন্যায়। আমরা চাইব সমগ্র ভাবনার বাইরে থেকে প্রকৃত মেধা চর্চার মূল্যায়ন হোক। গাইড বই আর কোচিং কালচার থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষার্থীরা আবার সামগ্রিকভাবে পাঠ্যবই চর্চায় মনোনিবেশ করুক। অহেতুক নানা নামের পরীক্ষার চাপে ভারাক্রান্ত না হয়ে মুক্তভাবে পাঠ গ্রহণের মতো অবকাশ পাক। এ-প্লাস-এর পেছনে ছোটার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে রেহাই পেয়ে সিলেবাসের বাইরেও মুক্তপাঠ, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চা সকল কিছুতে নিজেকে যুক্ত করুক।
ফলাফল বিস্ফোরণের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা দিয়েছে ভর্তি জটিলতা। বিস্তর এ-প্লাস থাকার কারণে ভালো স্কুল কলেজগুলো ভর্তির জন্য উচ্চ ফলাফল নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রিত কলেজগুলোও ফলাফলের ভিত্তিতেই ভর্তি সহজীকরণ করেছে। এ কারণে অনেক অভিভাবক তার সামর্থ্যকে অতিক্রম করেও কোচিং থেকে কোচিংয়ে ছুটছেন। যান্ত্রিকভাবে একটি ভালো সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য। এ কারণেই উচ্চ ফলাফলে রাশ টানায় অনেকেই হতাশ ভবিষ্যত্ চিন্তায়। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দেশে এসবের সমন্বয় করে সুস্থ ধারা তৈরি করা কঠিন। এ থেকে বেরুতে হলে দীর্ঘদিনের অচলায়তন ভাঙতে হবে। সকলকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর হওয়া ছাড়া জীবন গঠন সম্ভব নয় এমন ধারণা থেকে সরিয়ে এনে অন্য বাস্তবতায় দাঁড় করানো এখন জরুরি। আধুনিক বিশ্ব অনেকটা সে ধারায় এগিয়ে চলছে। এইচএসসি পর্যায় পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষা শেষ করে যার যার মেধা অনুযায়ী নানা ক্ষেত্রে ডিপ্লোমা ট্রেনিং নেবে। তেমন ব্যবস্থা রাষ্ট্রকেই তৈরি করতে হবে। দেশের আমলা, ব্যাংকার, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সকল পেশাজীবীরা আসবে এসব প্রতিষ্ঠানের অধীত জ্ঞান নিয়ে। যারা উচ্চতর গবেষণায় যুক্ত থাকতে চাইবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা খোলা থাকবে তাদের জন্য। তবে দীর্ঘদিন থেকে আমাদের মনোজগত্ ও সমাজ জীবন যেভাবে তৈরি হয়ে আছে এমন রূপান্তর ঘটানো একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রয়াস হতে পারে। কিন্তু এ পথে হাঁটতে না পারলে শিক্ষিত বেকারের বোঝা ক্রমে বড় হতে থাকবে।
তবে যে ধারায়ই শিক্ষার বিস্তার ঘটুক, তা যেন সার্টিফিকেটে আটকে না থেকে মানোন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়। আর এ জন্য যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানো উচিত, তার সামান্য লক্ষণ যেন দেখা দিয়েছে এ সময়ের উত্তরপত্র মূল্যায়ন ও ফলাফলে স্বাভাবিক ধারা ফিরে আসার প্রবণতায়। এটুকুই এখন বড় স্বস্তি।
লেখক: অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
সৌজন্যে: ইত্তেফাক