একজন খাঁটি অনুসন্ধানী সাংবাদিক : মং জার্নি - দৈনিকশিক্ষা

একজন খাঁটি অনুসন্ধানী সাংবাদিক : মং জার্নি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

‘আমি সেরে উঠছি। আপনার পরিবারের সবার প্রতি আমার ভালোবাসা রইল।‘ —মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে ৫ ও ৬ জানুয়ারি আমার যেসব ই–মেইল চালাচালি হচ্ছিল, তার মধ্যে এটি ছিল তাঁর আমাকে লেখা শেষ কথা। হাসপাতালের শয্যায় শুয়েই তিনি আমার সঙ্গে ওই দুদিন ই–মেইলে কথা বলছিলেন।

আমার বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠার শেষ দিকে। আমার বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক এবং আমার জন্মভূমিতে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজনের মরণের ওপারে চলে যাওয়ার তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। আমি যেহেতু মিয়ানমার থেকে স্থায়ীভাবে নির্বাসিত হওয়া একজন মানুষ, সেহেতু সেখানে আমার স্বজন ও বন্ধুদের শেষ সময়ে বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আমি উপস্থিত থাকতে পারিনি।

ঢাকায় মিজান ভাইয়ের চিরপ্রস্থানের বেদনাবিধুর খবর আমাকে প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত করেছে। তাঁর মধ্যে আমি আমার প্রিয় মানুষকে খুঁজে পেয়েছিলাম। উষ্ণতা, উদারতা, ভালোবাসা, অক্লান্ত পরিশ্রম করার ইচ্ছা, সর্বোপরি সত্য খোঁজা এবং সত্য বলার দুর্দমনীয় ইচ্ছায় তিনি পূর্ণ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব মাত্র তিন বছরের। কিন্তু আমাদের সম্পর্কের মধ্যে খুব সাবলীল ও অকৃত্রিম একটি মিথস্ক্রিয়া ছিল।

মিজান ভাই এবং আমার প্রথম দেখা হয় কুয়ালালামপুরের ইউনিভার্সিটি অব মালয়ে। সেখানে ২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ও মুসলিম নির্যাতনের বিষয়ে আলোকপাত করে পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনাল অন মিয়ানমার (পিপিটি) শীর্ষক একটি গণ–আদালত বসানো হয়েছিল। সেখানে আমরা দুজনই যোগ দিয়েছিলাম। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হাতে রোহিঙ্গা নির্যাতন এবং ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে পিপিটির দিনব্যাপী গণশুনানিতে আমি হাজির ছিলাম। ওই দিন মিজান ভাই এক দিনের মধ্যে এন্ট্রি ভিসার ব্যবস্থা করে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরে উড়ে চলে এলেন। মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধকে আনুষ্ঠানিকভাবে পিপিটির পক্ষ থেকে গণহত্যা বলে ঘোষণা করার অনুষ্ঠানটির সংবাদ পরিবেশন করার জন্য ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি কুয়ালালামপুর নামলেন। ওই গণশুনানিতে অংশ নেওয়া জেনোসাইড ওয়াচের প্রেসিডেন্ট গ্রেগরি স্টেনটনসহ বেশ কয়েকজন সুপরিচিত গণহত্যাবিষয়ক গবেষক ও আইনজ্ঞের সাক্ষাৎকার নিলেন। সেগুলোর ভিত্তিতে প্রথম আলোতে তাঁর লেখা ধারাবাহিক প্রতিবেদন বেরিয়েছিল।

মিজান ভাই দৈনন্দিন ঘটনার বিবরণ দিয়ে যাওয়া এবং দিনের নতুন স্বাদের নতুন প্রতিবেদন তৈরিতে আগ্রহী কোনো সাংবাদিক ছিলেন না। মিয়ানমারে দশকের পর দশক সরকারি বাহিনী ও স্থানীয় বর্মিদের খুন, ধর্ষণ ও সর্বাত্মক নির্যাতনের শিকার হওয়া রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তিনি গভীরভাবে সংবেদনশীল ছিলেন। রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে এবং বেঁচে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কতটা অসহায় অবস্থায় রয়েছে, তা নিজের চোখে দেখানোর জন্য তিনি তাঁর কন্যাকে কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আমার গবেষণা সহযোগী ও স্ত্রী নাতালি ঢাকা হয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পথে ঢাকায় মিজান ভাইয়ের বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। নাতালিকে তাঁর পরিবারের সদস্যরা উষ্ণ আতিথ্যে বরণ করে নিয়েছিলেন।

মিজান ভাই ছিলেন খাঁটি অনুসন্ধানী সাংবাদিক। বিভিন্ন বিষয়ের পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি ও অকৃত্রিম হৃদ্যতাপূর্ণ অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে করতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের কাছে আইনি দিকগুলো নিয়ে প্রশ্ন করতেন।

আমি তাঁর বিষয়ে যত দূর জেনেছি, তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিষয় ছিল হিসাববিজ্ঞান; কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি শুধু নিজের চেষ্টায় তাঁর দেশের সাংবিধানিক আইন শিখেছিলেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জাপানের একদল গণহত্যা ও আইনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ কক্সবাজারের শরণার্থীশিবিরে গাদাগাদি করে বাস করা রোহিঙ্গাদের দুঃখ–কষ্ট স্বচক্ষে দেখার জন্য এসেছিলেন। ওই দলে আমিও ছিলাম। মিজান মধ্যরাত পর্যন্ত আমাদের দলের সদস্যদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।

আমি যখন সেই দলের সদস্যদের কাছে মিজানের মৃত্যুর খবর জানালাম, তখন প্রত্যেকেই দারুণভাবে মর্মাহত হলেন। টোকিওর গাকুশুইন ইউনিভার্সিটির (সাবেক ইম্পেরিয়াল কলেজ) আইন অনুষদের অধ্যাপক মিশিমি মুরানুশিকে আমি যখন মিজানের মৃত্যুসংবাদ দিলাম, তখন তিনি বললেন, তিনি এমন একজন ব্যতিক্রমী বিনয়ী সাংবাদিক ছিলেন, যিনি কারও সাক্ষাৎকার নিলে সাক্ষাৎকারদাতা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যে মত দিতেন, সেটি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতেন, যদিও তিনি নিজেই সেই বিষয়ে বারবার চিন্তাভাবনা করতেন এবং খোঁজখবর করতেন। এমনকি কখনো কখনো সাক্ষাৎকারদাতার চেয়েও বেশি। ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার ল স্কুলের অধ্যাপক জন প্যাকার তাঁর এ কথায় সম্পূর্ণ একমত বলে মত দেন। মিজান ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে তাঁকে স্মরণ করে মানবাধিকার আইনজীবী ডরিন চেন বলেছেন, তিনি একজন অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বিশ্লেষক এবং রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিবিড়ভাবে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন।

এই কয়েক বছরে মিজান ভাইয়ের সঙ্গে আমার বহু ই–মেইল আদান–প্রদান হয়েছে। ঢাকায় তাঁর সঙ্গে কয়েকবার মুখোমুখি আলাপ হয়েছে। এই সময়ে ঢাকায় হোটেলে তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশি খাবার খেয়েছি।

মিজান ভাই শুধু পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন না, তিনি মিয়ানমারে গণহত্যা থেকে বেঁচে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একজন সত্যিকারের সমব্যথী মানুষ ছিলেন।

মিজানুর রহমান খানের মৃত্যু আমাদের অনেকের কাছে, বিশেষ করে আমার কাছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। তাঁর মৃত্যুতে, বিশেষ করে রোহিঙ্গারা তাঁদের এক অকৃত্রিম বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীকে হারাল।

ইংরেজি থেকে ভাষান্তরিত

লেখক : মং জার্নি, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মিয়ানমারের মানবাধিকারকর্মী।

সূত্র : প্রথম আলো

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041098594665527