আমি আমার নিজ উপলব্ধি থেকে বুঝি ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন। এই মুক্তি ছিলো একটি জাতিগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি। উপলব্ধি থেকে বলছি এই কারণে যে, বাংলাদেশের সমবয়সী আমি। একাত্তর, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বর এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধিকার আন্দোলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষ কোনো যোগসূত্র নেই আমার। কারণ, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মায়ের কোলে শরণার্থী হয়েছিলাম। তাই বাংলাদেশের জন্ম তথা ইতিহাস সম্পর্কে যেটুকু জেনে আসছিÑতা স্বাধীনতাকামী মানুষদের কাছ থেকে, ইতিহাসের পাঠ থেকে। এখনো ৭ মার্চের ভাষণ শুনে সহজেই বুঝতে পারি। এই ভাষণ কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়, এটি সর্বকালের, সব সময়ের। বাঙালি জাতির আদর্শ ও চেতনার বর্হিপ্রকাশ হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ।
কালে-কালে বহুদেশে অনেক নেতার জন্ম হয়েছে কিন্তু বাঙালির অবিসংবাসিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানই; তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে একাত্তরের ৭ মার্চ, মাত্র ১৯ মিনিটের এক ভাষণের মধ্যদিয়েÑ একটি জাতিকে স্বাধীনতাকামী করে তোলা হয়। এই কালজয়ী ভাষণই একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে পরিণত করেছিলো। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে তুলে ধরেছেন, পাকিস্তান সরকার তথা পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান) প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ আচরণ, অধিকার বঞ্চিত করার ইতিহাস। যে ভাষণে উঠে এসেছে পাকিস্তানি শাসকদের বাঙালির অধিকার-বঞ্চনার দীর্ঘ ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, নিরীহ বাঙালির ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ইতিহাস। বাঙালির বুকের রক্ত দিয়ে ২৩ বছরের রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বক্তৃতার শুরুতেই কোনোরকম আনুষ্ঠানিক সম্বোধন না করেই ‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি’ বলে শুরু করেন। এরপর তিনি বললেন, ‘নির্বাচনের পর বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে ও আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ এই বাক্যগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ, নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। ২৫ তারিখে আহূত অ্যাসেম্বলিতে যোগদান প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন ও সম্প্রদায়ের কথা মাথায় রেখে এবং তাকে যেনো বিচ্ছিন্নতাবাদীর অভিযোগ না দেয়া হয় সেই জন্য অত্যন্ত বিজ্ঞ ও চাতুর্যের পরিচয় দিতে হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথমে সামরিক আইন তুলে নিতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত যেতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’
জনসভা যখন চলছে তখনো মাথার ওপর হেলিকপ্টার ঘুরছে, যেকোনো সময় হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এরকম একটি সময়ে তিনি সরাসরি জনগণকে আইন অমান্য করার নির্দেশ দিলেন এবং দেশ এখন তার কথায় চলবে সেই নির্দেশনাও দিলেন। তিনি বললেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ এর পরপরই তিনি শত্রুদের মোকাবিলার কৌশলও বলে দেন। তিনি গর্জে উঠলেন ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’ ভাষণের শেষে তিনি ডাক দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’ সেদিনের এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালি আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা না করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো।
৭ মার্চের ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এ ভাষণের মধ্যে দিয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এই ভাষণ প্রজ্জ্বলিত করেছিরো মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশিখা। বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আরো ছিলো- সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। এ চারটি শর্ত দিয়ে একদিকে তিনি আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখলেন, অন্যদিকে ভাষণ শেষ করলেন, ‘...এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে। এই বাক্যগুলো উচ্চারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কার্যত দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সক্রিয় এবং মনোগতভাবে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
৭ মার্চের ভাষণ নানা বিশ্ব নেতৃত্ব এবং মিডিয়াকেও আলোড়িত করেছিলো। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতোদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততোদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমও ৭ মার্চের ভাষণকে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
৭ মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাস সংগ্রামী জনতাকে উজ্জীবিত রেখেছে। নেতা পাকিস্তান কারাগারে বন্দি। বেঁচে আছেন কি না, থাকলেও কেমন আছেন তাও জানা নেই কারো। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে বার বার প্রচারিত ওই ভাষণ বিপন্ন মানুষকে সজীব রেখেছে, সাহস যুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার কণ্ঠই মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। ১১০৮টি শব্দ সম্বলিত অপূর্ব হৃদয়গ্রাহী এ ভাষণে যেমন ছিলো বাঙালির ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস, রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করার ইতিহাস, ছিলো নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করার পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠার ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতি সম্বলিত দিক-নির্দেশনা দিয়ে বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বানও প্রতিধ্বনিত হয়েছে এ ভাষণে। ভাষণের আরেকটি অনন্য দিক ছিলো ‘civil disobedience’ এর সরাসরি নির্দেশনা। তাই বলা যায়, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তা ছিলো কেবল আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। ৭ মার্চের ভাষণেই রয়েছে স্বাধীনতার মূলমন্ত্র।
একটি জাতির আবেগ, দ্রোহ ও স্বাধীনতার দাবিকে মাথায় রেখে ভাষার যে নিপুণতা ও শব্দ তিনি ভাষণে ব্যবহার করেছেন, তা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বক্তা ও রাজনীতিবিদের পক্ষেই সম্ভব। এখানে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিল্লুর রহমান খানের মূল্যায়ন তুলে ধরছি। তিনি লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান এমন এক রাজনৈতিক নেতা, যিনি ক্যারিশম্যাটিক এবং একই সঙ্গে একান্তই স্বদেশীয়। মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহরু, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ-এরা সবাই পাশ্চাত্যে শিক্ষা লাভ করেছেন। বঙ্গবন্ধু পড়াশোনা করেছেন গোপালগঞ্জ, কলকাতা ও ঢাকায়। তিনি যা ভাবতেন, জনগণ সেটাই করতেন।’
বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের রাজনীতি; গরিব-দুঃখী মানুষের রাজনীতি। স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। পেয়েছি শহীদের রক্তে লেখা পবিত্র সংবিধান। আজ বাংলার ১৮ কোটি মানুষের অন্তরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশপ্রেমের চেতনা, ৭ মার্চের ভাষণের ঐতিহাসিক শক্তি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ‘দ্বীপশিখা’র মতো প্রজ্জ্বলিত। বঙ্গবন্ধুর গড়া বাংলাদেশ আমার, আমাদের, সকল প্রজন্মের। তাই ৭ মার্চের চেতনায় এ দেশকে গড়তে হবে। এই চেতনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক