দানশীলতায় যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য - দৈনিকশিক্ষা

দানশীলতায় যাকাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

মো. জিল্লুর রহমান |

ইসলাম দুস্থ মানবতা ও নিঃস্ব-গরিবের স্বার্থ সংরক্ষণের ন্যায়সংগত অধিকার বা হকগুলো ফরয করে দিয়েছে। ইসলামী অর্থনীতিতে সর্বপ্রকার ধন-সম্পদ বণ্টনের মূলনীতি সম্পর্কে যাকাতের নির্দেশনা রয়েছে এবং যাকাতের মাধ্যমে মানবসমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য বিশেষভাবে দিকনির্দেশনা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘ধন-সম্পদ যেন শুধু তোমাদের ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়’- (সূরা আল-হাশর, আয়াত-৭)। এছাড়া,‘ধনী লোকদের সম্পদে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের নিশ্চিত অধিকার রয়েছে’- (সূরা আল-যারিআত, আয়াত-১৯)।

দানশীলতা’ মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি মহৎ গুণ। কুরআন এবং হাদিসে দান-সদকার বহু ফজিলত বর্ননা করা হয়েছে। হাদিস বলা হয়েছে, ‘দানশীলতা জান্নাতের একটি বৃক্ষ। যা তাকে জান্নাতে পৌঁছে দেবে’- (মিশকাত শরীফ)। এই ফজিলত হচ্ছে যেকোন সময়ের জন্য, কিন্তু রমযানে দান-সদকার জন্য রয়েছে বিশেষ ফজিলত। যা ধর্মপ্রাণ এবং আর্থিক সামর্থ্যবান সকল মুসলমানদের জন্য খুবই সু-সংবাদ।

যাকাত ইসলামের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন বা ইবাদত। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত ও যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। যাকাতের আভিধানিক অর্থ পরিশুদ্ধ হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া। যাকাতের পরিভাষায়, কোন দরিদ্র মুসলমানকে শরীয়ত বিচারে মালের নির্ধারিত অংশের মালিক বানিয়ে দেয়া। 

অনেকের মনে খটকা লাগে বা সন্দেহ জাগে, যাকাত দিলে দৃশ্যত সম্পদ কমে, তাহলে কিভাবে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। আসলে যাকাত দিলে সম্পদ যেমন পবিত্র হয়, ঠিক তেমনিভাবে আল্লাহ উক্ত সম্পদের জিম্মাদার হয়ে যান, উক্ত সম্পদের কেউ ক্ষতি বা বিনষ্ট করতে পারে না। যদি সঠিক নিয়মে যথাযথভাবে যাকাত প্রদান করা হয়, তবে সে সম্পদ চুরি হয় না, আগুনে পোড়ে না, পঁচে না, নষ্ট হয় না, কেউ আত্মসাৎ করতে পারে না। 

দৈহিক ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নামাজ, ঠিক তেমনিভাবে আর্থিক ইবাদতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যাকাত। সীমাহীন গুরুত্বের কারণে এই দুইটি ইবাদতের কথা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে পাশাপাশি বর্ণনা করেছেন। ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজিদে ৮২ স্থানে নামাজের সাথে সাথে যাকাতের কথা উল্লেখ করেছেন এতে প্রমাণিত হয় যে, দৈহিক ইবাদত হিসেবে নামাজ যেমন খুবই জরুরি, তেমনি আর্থিক ইবাদত হিসেবে যাকাতও সম-জরুরি। এছাড়া নামাজ এবং যাকাত একটি অপরটির সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ ও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা অনেকে হিসাব নিকাশ না করে কিছু অংশ যাকাত মনে করে দান করি, আসলে এধরনের দান যাকাত হিসাবে পরিগণিত হয় না, সাধারণ দান হতে পারে। যাকাত প্রদানের সময় যথাযথভাবে পরিমাণ হিসাব করে দান করতে হয় এবং তখনই যাকাতের হক আদায় হয়।

যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ : ১. নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া। ২. মুসলমান হওয়া। কাফেরের ওপর যাকাত ফরয নয়। ৩. বালেগ হওয়া। নাবালেগের ওপর যাকাত ফরয নয়। ৪. জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার ওপর যাকাত ফরয নয়। ৫. স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর ওপর যাকাত ফরয নয়। ৬. মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার ওপর যাকাত ফরয হয় না। ৭. নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া। ৮. নেসাব পরিমাণ মালের ওপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া। ৯. মাল বর্ধনশীল হওয়া। যাকাতের ফজিলত, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা যা কিছু (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় কর তিনি তার বিনিময় দান করবেন। আর তিনিই উত্তম রিজিকদাতা’- (সুরা সাবা, আয়াত ৩৯)।                          

যিনি যাকাত দেবেন না, কিয়ামতের দিন তার জায়গা হবে জাহান্নামে’- (তাবারানী)। অন্য এক হাদিসে আছে, আল্লাহ তাআলা যাকে ধন-সম্পদ দান করেছেন তিনি যদি ঐ সম্পদের যাকাত আদায় না করেন, তাহলে তার সম্পদকে কিয়ামতের দিন তাকে বিষধর সাপের রূপ দান করা হবে। যার চোখের উপর দুটি কালো দাগ থাকবে যা কিয়ামতের দিন তার গলায় বেড়ির মত পেঁচিয়ে দেয়া হবে। অতপর সে সাপটি তার চোয়ালে দংশন করে বলতে থাকবে আমিই তোমার সম্পদ, আমিই তোমার কুক্ষিগত মাল’- (বুখারী শরীফ, ১/১৮৮)।

সুরা তওবার ৬০ নং আয়াতে যাকাতের ৮ টি খাত উল্লেখ করা হয়েছে। ১. ফকির- ঐ গরিব ব্যক্তি যার নিকট এক বেলা বা দুই বেলার বেশি খাবারের ব্যবস্থা নেই। ২. মিসকিন- যার আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ৩. যাকাত আদায় ও বিতরণ ৪. নওমুসলিম অর্থাৎ যারা অন্য ধর্ম ছাড়ার কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে বঞ্চিত হয়েছেন, তাদেরকে দেয়া। ৫. দাসমুক্তির জন্য । ৬. ঋণ মুক্তির জন্য। জীবনের মৌলিক বা প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরনের জন্য সংগত কারণে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণ মুক্তির জন্য যাকাত দেয়া যাবে। ৭. ফী সাবিলিল্লাহ বা জিহাদ। অর্থাৎ ইসলামকে বোল-বালা বা বিজয়ী করার লক্ষে যারা কাফির বা বিধর্মীদের সাথে জিহাদে রত সে সকল মুজাহিদদের প্রয়োজনে যাকাত দেয়া যাবে। ৮. মুসাফির- মুসাফির অবস্থায় কোনো ব্যক্তি বিশেষ কারণে অভাব গ্রস্ত হলে ঐ ব্যক্তির বাড়িতে যতই ধন-সম্পদ থাকুক না কেন তাকে যাকাত প্রদান করা যাবে।

যাকাতের মাধ্যমে সমাজে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা হয়। ধনীরা তাদের উদ্বৃত্ত সম্পদের সাধারণত ৪০ ভাগের এক ভাগ বছর শেষে যাকাত প্রদান করে মানব সেবায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। ইসলামী বণ্টন ব্যবস্থায় ধনীরা তাদের ধন-সম্পদের কিছু অংশ দরিদ্রদের যাকাত দিলে গরিবদের সম্পদ কিছুটা বেড়ে যায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীভূত হয়। এভাবে ধনীর আয়-রোজগার থেকে নির্ধারিত কিছু অংশ কমিয়ে এবং সেই কমানো অংশ হতদরিদ্রদের আয়ের সঙ্গে যোগ করে ইসলামের বিধান অনুযায়ী যাকাত বণ্টনের ফলে সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা পায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা সম্পদশালীদের ওপর সদকা (যাকাত) অপরিহার্য করেছেন, যা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা হবে’- (বোখারি ও মুসলিম)। 

পবিত্র কোরআনে অসংখ্য আয়াতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যাকাত, সদকা, ফেতরা আর ধন সম্পদ এবং তা ব্যয়ের বিষয়ে আলোচনা এসেছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক হকদারকে তার ন্যায্য অধিকার দিয়ে দাও’- (বোখারি)। সমাজে দরিদ্রদের মৌলিক অধিকার যেমন ইসলাম স্বীকার করেছে, পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তাদের সম্মানজনক মর্যাদাও দিয়েছে। নবী করিম (সা.) জানিয়েছেন, ‘আমির ও ধনী লোকের ৪০ বছর আগে দরিদ্র বা গরিব লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবেন।’ 

হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত এবং ব্যবসায়ের পথ ধরে উপার্জিত বিপুল সম্পদ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কল্যাণে, ইসলামের প্রয়োজনে উজাড় করে দিয়েছিলেন। নিজের আগামী দিনের প্রয়োজন আর পরিবার ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা কখনো তাঁর দানের হাতকে সংকুচিত করতে পারেনি। তাবুক অভিযানের সময় আল্লাহর রাসুলের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে প্রতিযোগিতামূলক দান করতে লাগলেন। সবার আগে তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদ আল্লাহর রাসুলের সামনে পেশ করলেন। হজরত উসমান (রা.) দিলেন ৯০০ উট, ১০০ ঘোড়া এবং বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সোনা। হজরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) দিলেন সাড়ে ২৯ কিলো রৌপ্য মুদ্রা। হজরত আস ইবনে আদি (রা.) দিলেন সোয়া ১৩ টন খেজুর। হজরত ওমর, তালহা, সাদ ইবনে উবাদা, মোহাম্মদ ইবনে মাসলামা (রা.) গোটা সম্পদের অর্ধেক দান করলেন। সবশেষে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু বকর! ঘরে কী রেখে এসেছেন? উত্তরে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলকে রেখে এসেছি।’ তাঁদের প্রত্যেকের দান ইসলামের ইতিহাসে সমুজ্জ্বল ও এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।  

লেখক : মো. জিল্লুর রহমান, সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা

 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065619945526123