দেশ-বিদেশে ঈদের সংস্কৃতি - দৈনিকশিক্ষা

দেশ-বিদেশে ঈদের সংস্কৃতি

রাহাত মামুন |

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম। এর উৎপত্তিস্থল আরব থেকে বাংলাদেশ ৬০০০ কিলেমিটার দূরে। যা নবী করিম (দ.) এর সময়কাল থেকেও আমরা কমপক্ষে সাড়ে ১৪০০ বছর পরের। কিন্তু ইসলামের সাথে বাংলাদেশের যোগসূত্র স্থাপিত হয় নবীর যুগ থেকেই। নবুওয়াতের সপ্তমবর্ষে (৬১৭ খৃস্টাব্দে) সাহাবী হজরত আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইব(রা.)’র চীনে আগমনই এ কথার পক্ষে জোরালো প্রমাণ বহন করে। 

সাহাবী হজরত কাসেম ইবনে হুজাইফা (রা.), উরওয়া ইবনে আসাসা (রা.), আবু কায়েস ইবনুল হারিসও (রা.)  চীনে যাওয়ার সময় বাংলাদেশের উপকূলে জাহাজ নোঙর করেন। জাহাজ থেকে ৪ সাহাবি এখানে নামেন এবং তারা এদেশে দু’বছর অতিবাহিত করেন। এরপর তাবেয়ীগণ বাংলাদেশে আসেন। পীর, আউলিয়া ও মুসলিম বিজয়ীগণ হাজার বছর ধরে এ দেশকে ভালোবেসে মুসলিম সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

আল্লাহর নবী মদীনা শরীফে হিজরত করার পর দেখলেন মদীনায় অন্য ধর্মের লোকেরা বার্ষিক ঈদ অনুষ্ঠান উদযাপন করে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায়ও ধর্মীয় ও জাতিগত উৎসব ছিল। পারস্যের লোকেরা "নওরোজ উৎসব" পালন করতো। নওরোজ অর্থ নববর্ষ। রোমানরা পালন করতো যীশুখৃস্টের জন্মোৎসব, বড়দিন। নবী করিম (দ.) একদিন আল্লাহর নির্দেশে মুসলিম জাতির ঈদ উৎসবের ঘোষণা দিলেন। বললেন, সব সম্প্রদায়েরই ঈদ (আনন্দ-উৎসব) আছে। এটি আমাদের ঈদ। অপরদিকে ১০ জিলহজ তারিখকে ঘোষণা করলেন কোরবানীর ঈদ হিসাবে। 

আরবী ঈদ শব্দটির অর্থ বার বার ফিরে আসা। পরিভাষায় ঈদ অর্থ উৎসব। একমাস রামাদানের রোজা শেষে শাওয়ালের নতুন চান্দ্র মাসের প্রথম দিনটিই ঈদুল ফিতর। ফিতর শব্দের অর্থ ভঙ্গ করা। একমাসব্যাপী রোজা ছেড়ে দিনের বেলা প্রথম পানাহার করা। পানাহার ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা শুরুর দিন ঈদগাহে দুই রাকাত নামাজ পড়ার মাধ্যমে এ ঈদ পালিত হয়। জিলহজ মাসের ১০ তারিখেও দুই রাকাত নামাজ পড়ার পর আল্লাহর দেওয়া হালাল পশু কোরবানীর মাধ্যমে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয। এ দুই ঈদেরই উদ্দেশ্য আল্লাহর মহানত্ব প্রচার করা এবং বান্দাদের রহমত, বরকত ও ক্ষমা লাভ। এ উৎসব ও আনন্দ সাম্য, মৈত্রী, সৌজন্য ও সম্প্রীতির।

একটি ভূখন্ডের সকল মানুষ সম্মিলিত জীবনে বিশেষভাবে যে কাজগুলো করে এসবই তাদের সংস্কৃতি। আরবী মৌল থেকে উৎসারিত এবং মধ্য এশিয়া থেকে আগত সংস্কৃত ভাষার শব্দ ‘সংস্কৃতি’ মূলত আরবী ‘সুন্নাতি’ শব্দের প্রতিবিম্ব। এ দুটি শব্দের ব্যবহারিক অর্থও খুবই কাছাকাছি।

বাংলাদেশের শতকরা ৯২ ভাগ মানুষ মুসলমান। তাদের জীবনে ইসলামী কৃষ্টি-সংস্কৃতি,  বোধ-বিশ্বাস ও চেতনার সাথে মিশে আছে বাঙালির জীবনযাত্রা। যেমন, বাঙালি মুসলমানের জীবনে আজান, নামাজ, মসজিদ, মাদরাসা, আলেম, পীর, মাশায়েখ, ওয়াজ, তাফসীর, সভা, মাহফিল, দাড়ি, টুপি, পর্দা, হিজাব, নেকাব, কিরাত, হামদ, নাত, জায়নামাজ, তাসবি, তারাবিহ  ইত্যাদি দুধচিনির মিলনের মতো মিশে আছে। ইসলাম মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, সহজাত অভ্যাস, খাদ্য, দেশজ রীতি-পদ্ধতিকে আপন করে নিয়েই অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে।

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এতে কোনো বিষয়ই পরিবর্তনীয় নাই। উৎসবেরও এখানে বিধান ও নৈতিক দর্শন রয়েছে। সাংস্কৃতিক রূপরেখা রয়েছে। এর আলোকে মানুষ সমাজ ও অর্থনীতির কারণে ব্যবহারিক বৈচিত্র্য থাকতেই পারে। তবে বিধান ও নৈতিক দর্শনে কোনো পরিবর্তন ইসলাম সমর্থন করে না। এ হিসাবে ঈদ অসংখ্য বিধান, নৈতিক ও মানবিক সৌন্দর্যের প্রকাশস্থল। যেমন, রমজান মানবতা, ধৈর্য, পরিশীলন, সহমর্মিতা, উদারতা, ক্ষমা, মাহাত্ম্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও পূণ্যসাধনার মাস। 

এরপরই আসে ঈদুল ফিতর। তো স্বাভাবিকভাবেই এতে ভ্রাতৃত্ব, মিলন, সম্প্রীতি, মানবিকতা, ক্ষমা, সৌজন্য ফুটে ওঠার কথা, যা মুসলিম সামাজে অবশ্যই পরিস্ফুট হয়। আর্থিক আদান-প্রদানও এসব বিধানের অনুসঙ্গ। ফিতরা সব মানুষকে সুখি-স্বচ্ছল ও সামাজিক করার বিধান। জাকাত অর্থ সম্পদের সুষম বণ্টনের ব্যাপক ব্যবস্থাপনা। ঈদ তখনই উৎসব হয়ে ওঠে যখন মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে মানুষে পরিণত হয়।

ঈদুল ফিতর। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক উৎসব এটি । মাসব্যাপী সিয়াম সাধনের পরই আসে মাহেন্দ্রক্ষন এ দিনটি। সারা বছর ধরেই মানুষ যেন অপেক্ষায় থাকে এ দিনটির জন্য। বাংলাদেশে এই দিনকে আনন্দমুখর, স্বরণীয় ও বরণীয় করে তোলার জন্য অনেক আয়োজন করা হয়।

মধ্যপ্রাচ্যের বৃহৎ মুসলিম দেশ সৌদি আরব। এখানে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয় ভিন্ন আঙ্গিকে। পুরুষরা ‘কান্দর’ নামের সাদা পোশাক পরে। নারীরা এই দিনে ‘থাউব’ নামের বিশেষ পোশাক পরে। 

সাংস্কৃতিক প্রাচুর্যের এ দেশে অত্যন্ত জমকালোভাবে উদযাপন হয় ঈদুল ফিতর। ঈদের দিনকে তুর্কিরা ‘রামাদান বেরামি’ বা রামাদান উৎসব ও ‘সেকার বেরামি’ বা মিষ্টির উৎসব বলে। ছোটরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। বড়দের ডান হাতে চুম্বনের মাধ্যমে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ইন্দেনেশিয়ায় ঈদের দিনকে বলা হয় ‘হারি রায়া ঈদুল ফিতরি’। ‘লেবারান’ হিসেবেও পরিচিত। ঈদের দিনে অতীতের কৃতকর্মের জন্য আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চায়। ঈদের এই বিশেষ দিনটিতে নারীরা পরে ‘কেবায়া কুরঙ্গ’ আর পুরুষরা পরে ‘বাজু কোকো’, যা এ দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক।

এদের ঐতিহ্য অনুযায়ী বিভিন্ন মুখরোচক খাবার রান্না হয় ঘরে ঘরে। খাবার তালিকায় থাকে মাংসের তৈরি ‘রেনডাং’, কাবাব বা ‘কেটুপাত’, ‘ডোডল’ বা এক ধরনের মিষ্টি। এ ছাড়া সে দেশের বিশেষ ঐতিহ্য বাঁশের মধ্যে রান্না করা ভাত, যা ‘লেমাং’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া ঈদের নামাজ, কুশল বিনিময়, সালামি দেওয়া, কবর জিয়ারত তো আছেই।

পিরামিডের দেশ মিশর ঈদ যাপনের ক্ষেত্রে অন্য দেশের চেয়ে এগিয়ে। একটানা চার দিন ঈদ উদযাপন করা হয়। মজাদার সব মাছের রান্না উৎসবকে করে তোলে রঙিন। নীলনদের দেশটির অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো ‘ফাত’, যা ভাত, মাংস, পেঁয়াজ, ভিনেগার সবকিছুর মিশ্রণে রান্না করা হয়।

রামাদান এবং ঈদের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসবে এরা খেজুরের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ‘ক্লাইচা’ নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার না থাকলে এদের অনুষ্ঠানই যেন অপূর্ণ থাকে। ক্লাইচা হলো এক ধরনের কুকি, যা বাদাম, খেজুর এবং গুলকন্দ দিয়ে বানানো হয়।
আফ্রিকার এই দেশটিতে ঈদ মানেই লোভনীয় খাবারের আয়োজন। এদের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি ‘হালভো’ খুব জনপ্রিয়, যা বানানো হয় তেল, চিনি, কর্নস্টার্চ এবং হরেকরকমের মসলা মিশিয়ে। তাদের ঈদের অনুষ্ঠানে হালভো আবশ্যক। আফ্রিকায় মুসলিম অধ্যুষিত এই দেশে ঈদ উদযাপন হয় আতশবাজি, ড্রাম ও বাঁশি বাজিয়ে।

এখানে ঈদকে দুই রকম নামে ডাকা হয়। সেখানকার ফার্সিভাষীরা ঈদকে বলে ‘ঈদ-ই-রমজান’, আর পশতুভাষীরা বলে ‘কোচনাই আখতার’। ঈদের দিনে এরা অতিথিদের খেতে দেন ‘জালেবি’ নামের বিশেষ খাবার। অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ফাঁকা ময়দানে পুরুষরা একত্রিত হয়ে একজন আরেকজনের দিকে সিদ্ধ ডিম ছোঁড়ে। 

ঈদ আসে ঈদ যায়। মুসলিম ঐতিহ্য তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখে নিজস্ব নিয়মে। ভাষা ও স্থান ভেদে ঈদ পালনে ভিন্নতা থাকলেও ঈদের সুর এক ও অভিন্ন। ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো সব ভেদ ভূলে ঈদগাহের এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্যের বাণী পৌঁছে দেওয়াই হচ্ছে ইসলামের লক্ষ্য । যে লক্ষ্য পুরণে ঈদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

লেখক : রাহাত মামুন, সহকারী শিক্ষক
 

 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070760250091553