নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা নয়, দরকার গঠনমূলক সুপারিশ - দৈনিকশিক্ষা

নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা নয়, দরকার গঠনমূলক সুপারিশ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এখন তুঙ্গে। কিন্তু সুপারিশ কোথায়? সমাজমাধ্যমে এই আলোচনা মূলত নেতিবাচকভাবেই ছড়ানো হচ্ছে। বৃহস্পতিবার (১৬ নভেম্বর) আমাদেরসময় পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সৌমিত্র শেখর। এসব আলোচনা-সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও নিজস্ব বক্তব্য এসেছে। এদিকে সংবিধান অনুসারে জাতীয় সংসদের নির্বাচন সমাগত। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধিতার রাজনীতিও চলছে এবং তাতে যোগ হয়েছে এই নতুন শিক্ষাক্রম। সম্প্রতি দেখা গেল, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নামে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’-এর ব্যানারে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়েছে। এই দাবিগুলো হলো : নতুন কারিকুলাম বাতিল বা সংস্কার; ৫০ অথবা ৬০ নম্বরে অন্তত দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু রাখা; নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন রাখাসহ ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখা; শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের ব্যয় সরকারের বহন করাসহ স্কুল পিরিয়ডেই সব প্রজেক্ট সম্পন্ন করা; শিক্ষার্থীদের দলগত ও প্রজেক্টের কাজে ডিভাইসমুখী হতে নিরুৎসাহিত করে তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করা; প্রতিবছর প্রতি ক্লাসে নিবন্ধন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করা এবং নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদে উত্থাপন করা। বোঝাই যাচ্ছে, অনেক ভেবেচিন্তে এতগুলো পয়েন্ট তারা বের করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা এমনটি চান? তাদের প্রথম দাবিটি মানলে তো আর কিছুই লাগে না! তারা জানেন, এই দাবি সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত নয়। তাই অন্য দাবিগুলো এখানে উত্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ তারাও জানেন, নতুন শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ বাতিলযোগ্য নয়।

পরীক্ষা লেখাপড়ার একটি মাপকাঠি নিশ্চয়। কিন্তু প্রচলিত পরীক্ষা-পদ্ধতিকে আপনি রীতিমতো নির্যাতন বলতে পারেন। আগে তো এক বছর পর বার্ষিক পরীক্ষা হতো। এখন বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে সেমিস্টার-পদ্ধতি চালু হওয়ায় সেটি ছয় মাস বা চার মাসে পৌঁছেছে। দুটির দুই সমস্যা। বাৎসরিক পদ্ধতির সমস্যা হলো, নির্দিষ্ট উত্তর মুখস্থ করে রাখতে হয় বারো মাস পর্যন্ত। বাস্তবে এটা কাজে আসে না। আর সেমিস্টার পদ্ধতিতে চার মাস পর পরই বা ছয় মাস অন্তর পরীক্ষা। এর মধ্যে আবার আছে মিডটার্ম। মানে একজন ছাত্র ভর্তি হয়ে শুধু পরীক্ষার মধ্যেই থাকে আর শিক্ষক থাকেন খাতা দেখা আর প্রশ্ন বানানোর মধ্যে। ইচ্ছে করেই এখানে ‘প্রশ্ন বানানো’ বললাম। একজন শিক্ষককে যখন বছরে বহুবার প্রশ্ন করতে হয়, তখন তিনি প্রশ্ন করার চেয়ে প্রশ্ন বানাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কাটিং-পেস্টিংয়ে ভরিয়ে তোলেন তার কম্পিউটার। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে আবার বলে দিয়েছেন, ৫০ বা ৬০ নম্বরের অন্তত দুটো লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তা হলে বাকি ৫০ বা ৪০ নম্বর কী হবে? সেটি কী স্থানীয় মূল্যায়ন হবে, স্পষ্ট করে বলা হয়নি। ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদির বদলে নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখার ব্যাপারে তাদের অবস্থান স্পষ্ট।

ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদিও যে এক প্রকার গ্রেড, এটি বোধকরি অভিভাবকশ্রেণি বুঝতে পারেননি। আমাদের প্রচলিত এ, বি, সি ইত্যাদি গ্রেডও কিন্তু সর্বত্র এক রকম নয়। কোথাও এ প্লাস হলো এক্সিলেন্ট, কোথাও এ-তে; কোথাও এ মাইনাস আছে, কোথাও এর অস্তিত্বই নেই; একই অবস্থা বি-এর ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বুয়েটে প্রথমবারের মতো গ্রেড পদ্ধতির মূল্যায়ন চালু হলে বেশ হইচই পড়ে যায়। মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রথম গ্রেড পদ্ধতি চালু হয় ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে। তখনো বেশ সমালোচনা হয়। পাস করা এই ছাত্ররাই ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসিতে জিপিএ পদ্ধতিতে প্রথম পরীক্ষা দেয়। খুবই কমসংখ্যক পরীক্ষার্থী প্রথমদিকে এ প্লাস পেয়েছিল। পরিসংখ্যানটি তুলে ধরি : ২০০১খ্রিষ্টাব্দে মাত্র ৭৬ জন এসএসসিতে এ প্লাস পায় আর ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসিতে এ প্লাস পায় সব মিলিয়ে ২০ জন। এখন কিন্তু এ প্লাস পাওয়ার সংখ্যা দুই লক্ষাধিক। অভিভাবকরা খুশি। তারা কি তা হলে সন্তানের শুধু অধিক নম্বর বা উচ্চ গ্রেডই কামনা করেন? এটিকে অনেকে গ্রেডের ‘ইনফ্লেশন’ বলে থাকেন। আমেরিকায় এমনটি হয়েছিল। আমেরিকা যখন ভিয়েতনামের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তখন সেনাবাহিনীতে প্রচুর জনবলের প্রয়োজন হয়। সে সময় ঘোষণা করা হলো, যারা মধ্যবর্তী গ্রেডে থাকবে তাদের যুদ্ধে যেতে হবে। এ অবস্থায় শিক্ষকদের কাছে অভিভাবকরা আব্দার জানায় আর শিক্ষকরাও নিজেদের মতো করে ব্যাপকভাবে উচ্চ গ্রেড প্রদান করেন, যাতে তাদের ছাত্রদের যুদ্ধে যেতে না হয়। এই উচ্চ গ্রেড প্রদানও গ্রেডের ‘ইনফ্লেশন’।

আমাদের দেশেও নানা সময় রাজনৈতিক কারণে গ্রেডের ইনফ্লেশন হয়েছে। অভিভাবকরা কিন্তু তাতে বেশ খুশি। তাদের সন্তানরা কী শিখছে, কতটুকু শিখছে তা তাদের ধর্তব্যের মধ্যে নেই। একটি মানসিকতা তৈরি হয়ে গেছে, বেশি করে পরীক্ষা হবে আর উচ্চ করে গ্রেড আসবেব্যস! এমনও তো প্রস্তাব এসেছিল, জিপিএ পাঁচের বদলে দশ করা হোক। তাতে গ্রেড পয়েন্ট আরও বেশি দেওয়া যাবে আর ছাত্ররাও খুশি হবে। কিন্তু ছাত্রদের তথাকথিত ‘খুশি’ করাই কি মূল কাজ? বিশে^র বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের গ্রেড মান্য হয়ে থাকে। যেমন, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে প্রচলিত এ, বি, সি, ডি, এফ ছাড়া আরও ছয়টি প্রতীক বা সিম্বল দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। সে ক্ষেত্রে তারকা, এস বা ইউ ইত্যাদি চিহ্ন তারা ব্যবহার করেন। শিশু শ্রেণিতে স্টার বা তারকা দিয়ে মূল্যায়নকে কি আমরা খুবই ফালতু হিসেবে দেখি? যদি না দেখি, তা হলে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্তকে আজ তির্যকভাবে দেখার কারণ কী? অভিভাবকদের একটি বক্তব্য আমার মনে ধরেছে এবং তা হলো অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে। নিশ্চয়। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। আমার সন্তান ঢাকার একটি স্কুলে যখন পড়ে তখন তাকে শ্রেণিকর্মের জন্য প্রায়ই এটা-ওটা কিনতে হতো এবং এজন্য আমাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হয়ে যেত। যে কাজ করার জন্য একটি পুরনো পত্রিকাই যথেষ্ট, সেই কাজ করানোর জন্য দামি আর্টপেপার বা রঙিন পোস্টার পেপার দিতে হতো। একবার তো তার শ্রেণি-নাটকের পোশাকের জন্য আমি পুরো ঢাকা শহর তল্লাশি দিয়েছিলাম! বুধবার সেই পোশাক লাগবে। মঙ্গলবার স্কুলে বলা হলো। মঙ্গলবার নিউমার্কেট এলাকা বন্ধ, গেলাম ফার্মগেট এলাকায়। সেটাও বন্ধ। গেলাম কাওরানবাজারে। সেখানে পেলাম না। পুরান ঢাকায় গিয়ে সে যাত্রায় আমার সন্তানের জন্য আমি শ্রেণি-নাটকের পোশাক এনে দিই। ভাবুন তো, একটি শ্রেণি-নাটকের জন্য কী অবস্থা। একে শিক্ষা বা পরীক্ষা না বলে অগ্নিপরীক্ষা বলাই ভালো! এমন অগ্নিপরীক্ষায় যাতে শিক্ষার্থীদের পড়তে না হয়, সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখা দরকার। শিক্ষকদের মনে রাখতে হবে, ছাত্রদের অভিজ্ঞতা নিতে ও দিতে হবে সম্ভাব্য ঘটনার মধ্য থেকে। এতে খরচাও কম হবে। আর এই কম খরচার ব্যাপারটি অবশ্যই প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানে দানকেন্দ্রিক স্থায়ী তহবিল গড়ে তুলতে হবে। আর সার্বিকভাবে আমি শিক্ষক-প্রশিক্ষণের ব্যাপারটিকে গুরুত্ব দেব। শিক্ষকদের যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দিতে না পারলে এই পদ্ধতির শিক্ষাক্রম আকর্ষণীয় করা কঠিন হবে। একটি অভিযোগ উঠেছে যে, শিক্ষকরা ছাত্রছাত্রীদের ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে বলেন। এটি হয়তো সর্বাংশে মিথ্যা নয়। শিক্ষকের অধিকারের বাইরে যদি বিষয় চলে যায় এবং তিনি যদি নিজেই না বোঝেন তা হলে ‘গুগোল-মামা’কে তিনি ভরসা হিসেবে দেখাতে পারেন। তবে এটি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আর একটি বিষয় হলো : আমাদের দেশে ইন্টারনেটকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘সেকশন’ করা এখন সময়ের দাবি। ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেট অত্যাবশ্যক। তাদের বয়স ও অভিজ্ঞতার আলোকেই ইন্টারনেট ‘সেকশন’ হবে এবং তারা সেটি নির্দ্বিধায় ব্যবহার করবে। এখন দেখা যায়, কাজ করতে গিয়ে বড়দের রুচিমতো কিছু ক্লিপিং এসে যায়। শিক্ষার্থীদের জন্য তা বারিত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য সেকশনকৃত ইন্টারনেটই উন্মুক্ত থাকবে, বড়দের জন্য থাকবে আরেক অংশ। এ কাজগুলো গুরুত্বের সঙ্গে করা প্রয়োজন। আশা করি, আগামী দিনে এ ব্যাপারে সরকারের আইসিটি বিভাগ গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করবে। এ সবকিছু একদিনে হবে না। তবে পরিকল্পনা করলে দ্রুতই তা সম্ভব হবে। এ কারণে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা নয়। গঠনমূলক সুপারিশ দিয়ে আমরা নতুন শিক্ষাক্রমকে এগিয়ে নিতে পারি।

লেখক : উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ

শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032551288604736