নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগ তুলে দেয়ার চিন্তা কেন? - দৈনিকশিক্ষা

নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগ তুলে দেয়ার চিন্তা কেন?

মাছুম বিল্লাহ |

বর্তমানে শিক্ষার্থীরা নবম শ্রেণি থেকে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের যেকোনো একটিতে যেতে পারে। এই বিভাগ তুলে দিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ২০১৯ সালের ২৫ ও ২৬ নভেম্বর এ বিষয়ে কক্সবাজারে এক আবাসিক কর্মশালার আয়োজন করে এনসিটিবি। সেখানে এসব প্রস্তাব ও পরিকল্পনা উঠে আসে। এনসিটিবি সূত্র জানায়, গুচ্ছ পদ্ধতিতে সবাইকে সব বিষয় পড়তে হবে বা বিষয় পছন্দের সুযোগ থাকবে। এতে একজন শিক্ষার্থী মাধ্যমিক স্তরে সব বিষয়ে জ্ঞান লাভ করবে। নবম শ্রেণিতে বিভাগ উঠিয়ে দেওয়া হলে ২০২৩ সাল থেকে নতুন কারিকুলামে বই দেয়া হবে।

পাবলিক পরীক্ষার সংখ্যা ও নম্বর কমিয়ে আনার প্রস্তাবও এসেছে ওই কর্মশালায়। এর ফলে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়নের পরিমাণ বাড়বে। শ্রেণিকক্ষে সব বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নে ২০ নম্বর রাখা হবে। এতে পাবলিক পরীক্ষার নম্বর কমে যাবে। বর্তমানে গার্হস্থ্য অর্থনীতি বা কৃষি পরীক্ষা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হচ্ছে। নতুন কারিকুলামে যুক্ত হবে আরো কিছু বিষয়। এ ছাড়া প্রাথমিকেও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক এমন বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাঠ্য বইয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জঙ্গিবাদ, নিরাপত্তা বিষয়গুলো যুক্ত করা হবে। শ্রেণিকক্ষে পড়ার পাশাপাশি কাজটি করে দেখানোর বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হবে। এগুলো ভালো প্রস্তাব, তবে শিক্ষকদের সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে, তা না হলে তালগোল পাকিয়ে যাবে সব কিছুতে।

বিভাগ তুলে দেওয়ার বিষয়ে এনসিটিবির এক মেম্বার-কারিকুলাম বলেছেন, গ্রাম এলাকায় বিজ্ঞানের শিক্ষক পাওয়া যায় না। তাই সবাইকে বিজ্ঞান পড়ানোর কোনো কারণ নেই। এ কেমন খোঁড়া যুক্তি? গ্রাম এলাকায় বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই বলে পুরো দেশের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিভাগ পড়া বাদ দিতে হবে? শহরে তো শিক্ষক আছেন, উপজেলায় শিক্ষক আছেন, গ্রামের বড় বড় বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক আছেন। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কি তাহলে যেসব বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই তাদের জন্য সেক্রিফাইস করে বিজ্ঞান পড়া বাদ দেবে? এখন বিশেষায়নের যুগ। গোটা বিশ্ব এখন বিজ্ঞানের মুঠোয়, বিজ্ঞান পড়ায় বরং শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে হবে, সেখানে আমরা আলাদা বিজ্ঞান পড়া বাদ দেওয়ার চিন্তা করছি! গ্রাম এলাকায় যেসব শিক্ষক আছেন তাঁদের বিজ্ঞান পড়ানোর মতো উপযুক্ত করে তুলতে হবে। তাদের সময় দিয়ে প্রস্তুত্তি নিতে বলতে হবে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে, বিদ্যালয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে, অনলাইনে বিজ্ঞান শিক্ষার আয়োজন করতে হবে। বিজ্ঞান পড়া বাদ দেওয়া যাবে না।

তিনি আরো বলেছেন, আমরা বিজ্ঞান শিখিয়ে শিক্ষার্থী বুয়েটে পাঠাচ্ছি, তারা দেশকে সার্ভিস দিচ্ছে না, সার্ভিস দিচ্ছে আমেরিকাকে। এ প্রসঙ্গে তো বহু কথা চলে আসে। বুয়েট কিংবা অন্যান্য উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যাঁরা পাস করে বের হন, দেশে আমরা কি তাঁদের মূল্যায়ন করতে পারছি বা করার চেষ্টা করছি কখনো? দেশে মূল্য তো ক্যাডারদের। শিক্ষার্থীদের ভেতরও ক্যাডারদের মূল্য বেশি, শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা ক্যাডারের চর্চা করেন, তাঁদের মূল্যায়ন ও প্রাপ্তি শিক্ষিত ও পড়ুয়াদের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। মেধাবী শিক্ষার্থীরা, যাঁদের দেশে কোনো সম্মান নেই তাঁরাই বিদেশের মাটিতে চরম কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন, অবিষ্কার করছেন অনেক কিছু। যে দেশ গুণীদের কদর করতে জানে না বা করে না, তাঁরা সেখানে থাকবেন কেন?

দ্বিতীয়ত, উন্নত বিশ্বে বিজ্ঞানপড়ুয়া যে শিক্ষার্থী যাচ্ছেন, তাঁরা তো অন্তত মানবজাতিকে তাঁদের মেধা দ্বারা সেবা দিতে পারছেন। তাঁরা দেশকে গোটা পৃথিবীতে অন্যভাবে পরিচিত করাচ্ছেন। আমেরিকায় বহু বাংলাদেশি মেধাবী শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রয়েছেন, যাঁরা বহু ভালো জব করছেন, এটি আমার নিজের দেখা। সব শেষে তাঁরা দেশে লাখ লাখ ডলার পাঠাচ্ছেন। কারণ তাঁদের সেখানে মূল্যায়ন করা হয়, তাঁরা যে সম্মানী পান তার বড় একটি অংশ তাঁরা দেশেও প্রেরণ করেন। অতএব বিজ্ঞান আমাদের পড়াতে হবে, বিজ্ঞানী তৈরি করতে হবে এবং উন্নত বিশ্বেও পাঠাতে হবে। আর সে জন্য নবম শ্রেণি থেকেই বিজ্ঞান পড়তে হবে। উন্নত বিশ্ব যেন এটিও জানে যে বাংলাদশের শিক্ষার্থীরা শুধু রাজনীতি আর রাজনীতির মারামারি এবং চাঁদাবাজি নিয়ে ব্যস্ত থাকে না, অনেক মেধাবী বিজ্ঞানীও এ দেশে আছেন। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীও বাংলাদেশে আছেন, তাঁরা দেশ, দশ ও গোটা বিশ্বকে সার্ভিস দিতে পারেন। বিজ্ঞান পড়ানো বাদ দিয়ে, বাণিজ্য পড়ানো বাদ দিয়ে আমরা কি শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছি?

তৃতীয়ত, নবম-দশম শ্রেণিতে বিশেষায়িত বিভাগে না পড়লে হঠাৎ করে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে কি তারা বিজ্ঞান কিংবা বাণিজ্য বিষয়ে ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারবে? উচ্চ মাধ্যমিকে এমনিতেই সময় কম, সিলেবাস থাকে বিশাল। হঠাৎ এত বড় পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের খাপ খাওয়ানোটা কঠিন হবে। দুই বছরের মধ্যে বিশেষায়িত বিষয়ে তারা কতটা দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, যার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা (মেডিক্যাল, ইঞ্জিনিয়ারিং, অ্যাগ্রিকালচার, সাধারণ) তারা গ্রহণ করবে?

আর একটি বিষয় হচ্ছে এনসিটিবি কি ইচ্ছা করলেই এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে? এনসিটিবির কি কোনো গবেষণা সেল আছে, যেটি গবেষণা করে দেখেছে যে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নবম-দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বা ব্যবসায় প্রশাসন আলাদা পড়ায় অনেক ক্ষতি হচ্ছে। একীভূত শিক্ষা হলে দেশ অনেক এগিয়ে যাবে কিংবা শিক্ষার্থীরা ভিন্ন ভিন্ন বিষয় একেবারেই বুঝতে পারছে না বা করতে পারছে না কিংবা দেশের খুবই ক্ষতি হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের জন্য বিশাল প্রমাণ থাকতে হবে, প্রকৃত গবেষণা থাকতে হবে, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষাবিদদের মতামত নিতে হবে। আমাদের সমপর্যায়ের দেশগুলোর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে, তাদের প্রচলিত পদ্ধতি ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। এনসিটিবি মনে করেছে, তাই নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগ থাকবে না, এটি তো কোনো কথা নয় কিংবা এনসিটিবির নতুন কিছু করতে হবে, তাই কিছু করা—এটিও খুব একটি গ্রহণযোগ্য কারণ হতে পারে না।

এনসিটিবিতে কর্মকর্তারা সরকারি কলেজ থেকে প্রেষণে আসেন। নির্দিষ্ট সময়ান্তে তাঁরা আবার চলে যান। কেউ কেউ হয়তো দীর্ঘদিন থাকেন। বিনা মূল্যের বই ছাপানোর যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, সেই কর্মযজ্ঞেই তো তাঁদের বেশি সময় চলে যায়। এনসিটিবির কোনো ধরনের গবেষণাকর্ম আমরা কখনো দেখেছি বা জেনেছি বলে মনে করতে পারছি না। হয়তো সীমাবদ্ধতার জন্য আমরা নিজেরাই জানি না, তবে করে থাকলে এনসিটিবিকেই দেশবাসীকে জানাতে হবে যে এসব প্রত্যক্ষ কারণে নবম-দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ রাখা যাবে না। সে ধরনের কোনো প্রমাণ তো আমরা দেখছি না, যে কারণে নবম-দশম শ্রেণিতে কোনো বিভাগ থাকবে না, সবাইকে একই বিষয় পড়তে হবে। এ চিন্তা তো জোরে শুরু হয়েছিল সেই ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে। তখন এনসিটিবি কেন করতে পারেনি বা করা হয়নি? কারণ বাস্তবতার সঙ্গে, বিশ্বায়নের সঙ্গে, যুগের সঙ্গে, রুচির সঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোন কোন বিষয়ে ঝোঁক রয়েছে তার মূল্য দিতে হয় ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নেওয়ার করণে ‘একীভূত শিক্ষা’ চালু করা যায়নি। এখন তো বিশেষায়নের যুগ, জেনারেল নয়, অর্ডিনারি নয়। আন্তর্জাতিক পরীক্ষা ‘ও’ লেভেলে কি সবাই এক বিষয় পড়ছে? তাহলে আমরা কেন চিন্তা করছি? সেখানে গ্রুপ বিভাজন আছে। তাহলে আমরা উল্টো চিন্তা করছি কেন?

এখন চিন্তা করা দরকার সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে, চিন্তা করা প্রয়োজন অদক্ষ শিক্ষকদের কিভাবে দক্ষ করা যায়, চিন্তা করা দরকার শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যাতে আসতে আনন্দ পায় সে ব্যবস্থা কিভাবে করা যায়, চিন্তা করা প্রয়োজন একজন শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষায় যে ফল অর্জন করবে সেটিই যেন বিশ্বাসযোগ্য হয়, পরবর্তী পর্যায়ে সেটিই যেন ভর্তির ক্ষেত্রে, চাকরির ক্ষেত্রে সঠিক প্রমাণিত হয়। বিজ্ঞান শিক্ষক নেই, তো সবার বিজ্ঞান পড়ার দরকার নেই কিংবা বিজ্ঞান পড়ে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যায়। বিজ্ঞানের যুগে কমার্স কিংবা কলা পড়ার দরকার নেই—এসব খোঁড়া যুক্তি দিয়ে একটি দেশের কারিকুলামের ভিত্তি দাঁড় করানো যায় না, করানো ঠিকও নয়।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077519416809082