প্রাথমিকের চেইন অব কমান্ড নিয়ে কথা - দৈনিকশিক্ষা

প্রাথমিকের চেইন অব কমান্ড নিয়ে কথা

মাছুম বিল্লাহ |

যে কোনো বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী থেকে শুরু করে সচিবালয় পর্যন্ত চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করা বিভাগীয় শৃংখলা পরিপন্থী কাজ। এতে একদিকে যেমন প্রশাসনিক কাজে বিঘ্ন ঘটে, অন্যদিকে সেবা প্রত্যাশী  ও যাদের প্রয়োজন তারা বিভাগীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হন। জন্ম নেয় স্বেচছাচারিতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি। একটির সাথে অপরটি জড়িত। এই চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গার কাজ প্রথম শুরু হয় এরশাদ আমলে। চেইন অব কমান্ড না মানার একটি প্রবাদ হচেছ ’ ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়া’। এটি সব যুগেই কমবেশি ছিলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি মেনে চলা খুবই জরুরি। আবার এই ব্যবস্থাতেই চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গার প্রবণতা দেখা যায় বেশি।

যে কোনো বিভাগের প্রশাসনে যারা থাকেন তারা যদি দ্রুততম সময়ে মাঠ পর্যায়ের কোনো কাজ করতে পারেন তাহলে কিন্তু কাজে জট বাঁধেনা, উপরে বলার কিংবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে বলার প্রয়োজন হয়না। কিন্তু সেই কালচার আমরা গড়তে পারিনি। 

অনেক সময় দেখা যায় কর্মকর্তাদের খেয়াল খুশিমতো কাজ করার ফলে এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। যে কাজটি এক সপ্তাহ কিংবা দুই সপ্তাহে হওয়ার কথা সেটি করতে যদি গড়িমসি করা হয়, কিংবা বিলম্ব করা হয় তখন দ্রুত সেবাপ্রাপ্তির আশায় সেবা প্রত্যাশীরা ‘ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়া’র চেষ্টা হয়তো করবেন। সেটি গড়ে তোলা হয়নি বলে ঘটে উল্টো ঘটনা। এছাড়াও রয়েছে অন্য কারণ। যেমন, একজন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী কিংবা শিক্ষক প্রোপার চ্যানেলে কাজ না করে তার কোনো প্রভাবশালী আত্মীয় উচচপদে আসীন থাকলে সেই ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাওয়ার চেষ্টা করেন। উচচ পদস্থ কর্মকর্তাকে তাই সেভাবে আচরণ করতে হয়। তা না হলে এই ছোট দেশে অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন উচচপদে আসীন। আধিকাংশই যদি এভাবে কাজ আদায় করতে চান তাহলে প্রকৃতরা বঞ্চিত হবেন, প্রশাসনে চেইন অব ভেঙ্গে পড়বে, কাজে আসবে স্থবিরতা ও বিশৃংখলা। মূলত এগুলোই ঘটছে এখন অধিকাংশ বিভাগেই। 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চেইন অব কমান্ড টিকিয়ে রাখা একটু বেশিই চ্যালেঞ্জিং। কারণ এ ব্যবস্থায় জনগণ তাদের নেতাদের সরাসারি ভোটে নির্বাচিত করেন। নেতৃবৃন্দকে সর্বদাই জনগণের কাছাকাছি থাকতে হয়, পাশে রাখতে হয়। জনগণ সহজেই চাইবেন যে, তারা কেনো সরকারি কর্মকর্তাদের ধার ধারবেন। তাদের নেতাদের মাধ্যমে তারা কাজ সারবেন। নেতৃবৃন্দকে তখন জনগণকে খুশি করার জন্য, সেবা প্রদানের জন্য, তাদের মন জয় করার জন্য অনেক সময় ইচছার বিরুদ্ধেও ’চেইন অব কমান্ড’ ভঙ্গ করার মতো কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়। কাজেই এটির সমাধান খুব সহজ কাজ নয়। মূল সমাধান হচেছ, কোনো বিভাগের প্রশাসনে যারা থাকেন কিংবা বিভাগীয় যে কোনো বিষয়ে যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা যদি সঠিকভাবে কাজ করে দেন, ক্ষমতার অপব্যবহার না করেন এবং তাদের সঠিক দায়িত্ব মনে করেন, তাহলে সহজে চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গার কালচার গড়ে ওঠেনা। 

আমাদের সমাজে অনেকেই জীবনে এ ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন এবং হচেছন। আমি একবার জিপিও-তে, জিপিও-র যখন যৌবন ছিলো (এখন তো আর জিপিও-র সে রকম কাজ নেই, ব্যস্ততা নেই, গ্রাহক সমাগম নেই) পোস্টাল ইনস্যুরেন্সের টাকা জমা দিতে গেলাম, তখন এ ধরনের এক পরিস্থিতিতে পড়লাম। আমি তখন রাজউক কলেজে কর্মরত। কলেজ থেকে ছুটি ম্যানেজ করে জিপিও-তে গিয়েছি এবং টাকা জমা নেওয়ার এক ঘণ্টারও বেশি সময় তখন হাতে ছিলো। এক নারী কর্মচারী আমার টাকা জমা নেবেন না। তার ইচেছ উনি এক ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় পূর্বে টাকা নেওয়া বন্ধ করবেন। সবিনয়ে বললাম, ‘আমি অনেক দূর থেকে এসেছি, আজকে জমা না নিল আমার আসাটা খুবই কষ্টকর হবে।’ উনি বললেন, ’ লন্ডন থেকে আসলেও আজ আর টাকা জমা নেব না। ওনার কাছাকাছি অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী সবই দেখেছেন, শুনেছেন, কেউ কিছু বলেননি। বাধ্য হয়ে আমি ডিপিএমজি বা ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেলের কাছে গেলাম। উনি তখন ওই সেকশনের একে এক সবাইকে ডাকালেন। তাঁর রুম দেখলাম কর্মকর্তা-কর্মচারীতে ভর্তি হয়ে গেলো। উনি আমাকে দেখিলে সবাইকে বললেন, ’এই ভদ্রলোকের টাকা জমা নেয়া হয়নি কেনো। সবাই সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, স্যার আমি তো জানি না। পরে উনিই বের করলেন কে টাকা জমা নেয়নি। মহিলা তখন বললেন, ‘স্যার ওনার দেরি হয়েছে।’ 

ডিপিএমজি বললেন, টাকা নেওয়ার সময় তো এখনও আছে। উনি তো আপনার ওখানে টাকা জমা দিয়ে গিয়েছিলেন, সাড়ে এগারটায়। তখন সবাই চুপ। তখন উনি নির্দেশ দিলেন, ‘ওনার টাকা জমা নিয়ে আমাকে জানাবেন।’ 

টাকা জমা দিলাম এবং প্রায় সবাই আমাকে বলছেন, ‘স্যার, আমাকে বলেন নি কেনো, স্যার আপনি আসলে কে?’ আমি বলেছিলাম, ‘আমি এ দেশের একজন নাগরিক এবং আপনার সবাই কিন্তু শুনেছেন ওই নারী কর্মচারী যখন আমাকে বলছেন- লন্ডন থেকে এলেও আজ আর টাকা জমা নেব না।

এ ধরনের ঘটান অহরহ ঘটছে। আর তাই ‘চেইন অব কমান্ড’ ভাঙ্গার প্রবণতাও দেখা দিচেছ। 

পত্রিকায় দেখলাম, অনেক প্রতিষ্ঠানই বিপন্ন বা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে এই চেইন অব কমান্ড সঠিকভাবে পালন না করার কারণে। কোনো প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় সে প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অবস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্ক এর মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। এখানে আদর্শ অবস্থান হচেছ প্রত্যেকে নির্ধারিত একজনের অধীনে কাজ করবেন। গ্রহণ করবেন তার আদেশ। তার কাছেই জানাবেন কার্যক্রমের বিবরণ। এর ব্যত্যয় কাজের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। অন্যের অধিকারে করে অযাচিত হস্তক্ষেপ। তবে, এই আদেশ ও নিষেধ প্রদানের ক্ষেত্রেও থাকতে হবে শালীনতা, প্রফেশনালিজম এবং সার্পোটিভ সুপারভিশন। তা না হলে আন্তরিকভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন হয়না এবং হচেছ না। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কথাটির অপব্যাখ্যার সুযোগ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীরা নিয়ন্ত্রণ করে প্রশাসন। এটি একটি বিব্রতকর অবস্থা। এ অবস্থার নিরসন না হলে শুধু দুর্বলদের কিংবা শিক্ষকদের উপর ‘চেইন অব কমান্ড’ ভাঙ্গার দোষ চাপালে খুব একটা কাজ হওয়ার কথা নয়। তাতে দুর্বলদের আরও ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। 

সম্প্রতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেইন অব কমান্ড মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে নানা অভিযোগ এসেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরাসরি সচিবের কাছে শিক্ষকদের অভিযোগ দাখিলকে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ বলে আখ্যায়িত করে অধিদপ্তর বলছে, এ কাজ অপরাধ। চেইন অব কমান্ড মেনে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করতে শিক্ষকদের নির্দেশনা দিতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এ নির্দেশনা দিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের চিঠি পাঠানো হয়েছে। গত ৯ ডিসেম্বর অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. নাছিমা বেগম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অভিযোগ দাখিল না করে সরাসরি সচিব বরাবর দাখিল করে চেইন অব কমান্ড ভঙ্গ করা হচেছ। যা অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। অভিযোগপত্রে অভিযোগকারী হিসেবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাম ব্যবহার করা হচেছ। এ অবস্থায় স্কুলগুলোর শিক্ষকদের চেইন অব কমান্ড মেনে চলার পরামর্শ দিতে ও ভবিষ্যতে এ ধরনের কাজ না করার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে চিঠিতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে। 

আমরা এ ধরনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে, খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা সবাই যেনো চেইন অব কমান্ড অনুসরণ করি, তা না হলে কাঙ্খিত সেবাপ্রাপ্তি অধরাই থেকে যাবে। কাউক বঞ্চিত করার জন্য, দুর্বলদের কথা বলতে না দেওয়ার জন্য কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য যাতে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত না নিই। কারণ এ দেশ আমাদের সকলের। আমাদের সকলকেই সঠিক সেবা দিতে হবে, তাদের প্রাপ্য দিতে হবে। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, লিড- এডুকেশন অ্যান্ড রিচার্স, দৈনিক শিক্ষাডটকম  

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066478252410889