যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তার জয়ের ফলে বিশ্বে এবং বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়তে পারে। এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবিরের মতে, প্রথমেই ইতিহাসের দিকে ফেরা যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে যে বিশ্ব ব্যবস্থা বা 'ওয়ার্ল্ড অর্ডার' গড়ে উঠেছে তার নেতৃত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্ব ব্যবস্থাটা কী, সে বিষয়ে একটু আলোচনা করা যায়। জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে শুরু করে বিশ্বে যতগুলো আন্তর্জাতিক সংঘ আছে তার প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে এখনও নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময় পর্যন্ত সেই নেতৃত্ব বলা যায় নিরবচ্ছিন্নই ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েক বছরে দেখা গেল, যুক্তরাষ্ট্র সেই বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গা থেকে ক্রমাগত নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে এলো, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় ভূমিকা কমে গেল, কভিড-১৯ মহামারির মতো অত্যন্ত নিদারুণ সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্র পিছটান দিল। এর ফলে বিশ্ব নেতৃত্বের জায়গা থেকেই মূলত যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ল; যার প্রভাবও দেখা গেল। কভিড-১৯ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাস হলো না! এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর ও নজিরবিহীন।
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের একটি অংশ বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এর কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বাংলাদেশ কিন্তু এখন পুরো দক্ষিণ এশিয়াতেই সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতির দেশ। এ কারণেই এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশের সামনে যে ব্লু-ইকোনমি সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য যে বাধাগুলো আছে, তা চিহ্নিত করে দূর করতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশি পণ্যের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। একটা বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্ব থেকে প্রতি বছর দুই থেকে তিন ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছয় থেকে সাত বিলিয়ন রপ্তানি করে মাত্র। এটা বাড়ানোর যথেষ্ট সুযোগ আছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র একটা খোলা অর্থনীতি। জো বাইডেন যদি এই খোলা অর্থনীতির দরজা আরও প্রসারিত করেন তবে সুযোগ আরও বাড়বে। আরও একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে- বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় বৃহত্তম রেমিট্যান্স আয়ের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে একটা উল্লেযোগ্য সংখ্যায় অভিবাসী আছেন অনিয়মিত। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি ছিল তাদের জন্য কঠোর। জো বাইডেন আগেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ অনিয়মিত অভিবাসীকে নিয়মিত করবেন। এটা হলে যুক্তরাষ্ট্রে অনিয়মিতভাবে থাকা বাংলাদেশিরাও উপকৃত হবেন এবং রেমিট্যান্সেও একটা প্রভাব পড়বে।
সবশেষে আসি রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে। এই সংকট নিয়ে বাংলাদেশের এখন জেরবার অবস্থা। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে। যুক্তরাষ্ট্র এগোলে চীন পিছিয়ে যায়, চীন এগোতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র পেছাতে থাকে। জো বাইডেন নির্বাচিত হলে যদি যুক্তরাষ্ট্র-চীন দ্বন্দ্বের অবসান হয় তাহলে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন যৌথ উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হবে এবং সেখানে ভারতকে পাওয়াও সহজ হবে। এর ফলে মিয়ানমারের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি এবং সংকটের স্থায়ী সমাধানও সহজ হবে। আগামী ১০ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচন। সেই নির্বাচনের পর রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই নির্বাচনে অং সান সু চি আরও বেশি ম্যান্ডেট নিয়ে এলে এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের যৌথ উদ্যোগ শুরু করা গেলে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের সম্ভাবনাও উজ্জ্বল হবে।