বেবী আপা : স্মৃতি আজও অম্লান - দৈনিকশিক্ষা

বেবী আপা : স্মৃতি আজও অম্লান

দুলাল আচার্য |

আজ ২৫ জুলাই সাংবাদিক বেবী মওদুদের প্রয়াণ দিবস। জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের এই দিন মৃত্যুর কাছে হার মানেন তিনি। পেশায় সাংবাদিক হলেও  সাহিত্যিক, নারী নেত্রী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সচেতন রাজনৈতিক কর্মী নানা অভিধায় তাকে মূল্যায়ন করা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করেছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নব্বইয়ের দশকে য্দ্ধুাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনেও সোচ্চার ছিলেন তিনি। কর্মজীবনে ‘সাপ্তাহিক ললনা’, ‘দৈনিক সংবাদ’, ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দৈনিক মুক্তকণ্ঠ’ ও ‘বিবিসি’-তে কাজ করেছেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার ‘বাংলা বিভাগ’টি গড়ে তুলে ছিলেন তিনি। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ছিলেন শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকও। জীবনের শেষ দিকে বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমের স্যোসাল অ্যাফেয়ার সম্পাদক ছিলেন। নবম জাতীয় সংসদের একজন সম্মানিত সংসদ সদস্য হিসেবে জনপ্রতিধিত্ব করেছেন বেবী মওদুদ।

সাপ্তাহিক বিচিত্রার কাজ করতে গিয়ে বেবী আপার লেখালেখি খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার। আমি এসবে যুক্ত থাকতে পেরে এখনো গর্ববোধ করি। বেবী আপা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীর প্রথম দিককার কাজগুলোতে তার শ্রম খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই কাজের সঙ্গে আমাকেও যুক্ত করেছিলেন তিনি। বিচিত্রার শেষের পাতায় প্রতি সপ্তাহে বেবী আপার একটি নিয়মিত কলাম বের হতো। ‘অন্তরে বাহিরে’ নামে এই লেখাগুলো সঙ্কলিত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। যাতে বেবী আপার ব্যক্তি জীবনের ছায়া ছিলো। শিশুতোষ বই ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বেবী আপার ছোট ছেলে শফিউল হাসান দীপ্তর (আমাদের পুটু মামা) জীবনের ছায়া অবলম্বনে। একজন প্রতিবন্ধী শিশুর বেড়ে ওঠার গল্প। লেখাটির সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি অনেকবার কেঁদেছি। অটিজম শিশুদের নিয়ে ‘দীপ্তর জন্য ভালোবাসা’ বইটি ছোটদের জন্য অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এক সময় দেখতাম বেগম রোকেয়ার নিজের লেখা এবং তার সম্পর্কীয় রেফারেন্সের কয়েকটি বই বেবী আপা অফিসে পড়ছেন। আর প্রতিদিনই কিছু কিছু পয়েন্ট চম্পকদাকে (সাপ্তাহিক বিচিত্রার কর্মী) কম্পোজ করতে দিতেন। কিছুদিন পর দেখলাম এগুলো সংযুক্ত করে হয়ে গেল ‘পবিত্র রোকেয়া পাঠ’। বেগম রোকেয়াকে সহজভাবে উপলব্ধি করার একটা অসাধারণ পুস্তিকা।

বেবী মওদুদ প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই তার খ্যাতি ব্যাপক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো-মনে মনে (ছোট গল্প), শেখ মুজিবের ছেলেবেলা, দীপ্তর জন্য ভালোবাসা, পবিত্র রোকেয়া পাঠ, টুনুর হারিয়ে যাওয়া, দুঃখ-কষ্ট ভালোবাসা, গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা, শান্তুর আনন্দ, মুক্তিযোদ্ধা মানিক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তার পরিবার, আমার রোকেয়া ও কিশোর সাহিত্য সমগ্র, নিবন্ধ সমগ্র ‘অন্তরে বাহিরে’।

তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন মূল্যায়ন করার মতো সঠিক ব্যক্তি বা যোগ্য মানুষ আমি নই। তবে আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন স্নেহময়ী মা, বড় বোনের প্রতীক। শেখ রেহানা সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতে গিয়ে বেবী আপাকে অনেক কাছ থেকে জানার সুযোগ হয় আমার। তার স্নেহধন্য হওয়ায় অনেক স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। আজ বেবী আপা নেই কিন্তু তাকে ঘিরে অনেক কথা, অনেক স্মৃতি মনে পড়ছে। বিশেষ করে মনে পড়ছে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাইর কথা। এদিন ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করে। সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে আমি অফিসে পৌঁছি। তখন বেবী আপা বিচিত্রার টিভি রুমে। একটি টিভি চ্যানেলে সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার, আদালতে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানাহেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। প্রিয় বন্ধুর জন্য বন্ধুর এমন ভালোবাসা ক’জনের থাকে জানি না। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য তার দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে! সেদিনের সেই দৃশ্য আজও বিস্মৃত।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কাছে এক বড় আবেগের নাম। সুধাসদনকে তিনি মনে করতেন তার সেকেন্ড হোম। প্রতিদিন সুধাসদনে যাওয়া যেন বেবী আপার রুটিন ছিলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার গ্রেফতারে তিনি প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়েন। নিঃসঙ্গ মনে হতো তাকে। অসহায়ের মতো বিচিত্রা অফিসে আসতেন। কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলতেন না। সময়টা এতোটাই বৈরি ছিলো যে, তখন আমাদের সবার মনেই এক অজানা আতঙ্ক। বিচিত্রা অফিসের চারদিকে সব সময়ই গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন ঘুর ঘুর করতো। অফিসে আসা-যাওয়ার মাঝেই বিষয়টা আমরা বুঝতে পারতাম। ইতোমধ্যে অনেক লেখক রহস্যজনক কারণে বিচিত্রায় লেখা বন্ধ করে দেন। এমনকি আয়ের উৎস যে বিজ্ঞাপন তাও অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিলো তখন। একদিন বেবী আপা বললেন, আর পারছি না। পত্রিকাটি বুঝি আর চালানো যাবে না। কোথায় পাব এতো টাকা? সে বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বিচিত্রা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। উল্লেখ্য, ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ অক্টোবর থেকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি থেকে শেখ রেহানার সম্পাদনায় নতুনভাবে, নতুন ব্যবস্থাপনায় পথচলা শুরু হয় বিচিত্রার। একই বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে বেবী আপার প্রত্যক্ষ নির্দেশে বিচিত্রায় আমারও পথচলা। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় পত্রিকাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিচিত্রায় সহ-সম্পাদক ছিলাম আমি। 

এবারের স্মৃতিটি নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত। সময়টা ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ। খবর পাঠালেন আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। একদিন সন্ধ্যায় লালমাটিয়ার তখনকার বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম অফিসে তার সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে একটি খাম দিয়ে বললেন এটা রাখো, মাওলা ব্রাদার্স লেখক সম্মানী দিয়েছে। আমিতো অবাক! আমি যে বিষয়টা বুঝিনি বেবী আপা সেটা বুঝতে পারলেন। তিনি ড্রয়ার থেকে একটি বই বের করে বললেন নাও। দেখলাম মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘নিঃসঙ্গ কারাগারে শেখ হাসিনার ৩৩১ দিন’ বইটি। বেবী আপা সম্পাদিত। বললেন এই বইয়ের প্রথমদিককার লেখাগুলো তোমার। উল্লেখ্য, বিচিত্রায় দিনলিপি কলামে প্রতিদিনকার ঘটনা লেখা হতো। গ্রন্থটিতে আমি ছাড়াও বেবী আপা এবং রঞ্জন দার [বর্তমানে কলকাতায় উপ-হাইকমিশনের প্রথম সচিব (তথ্য)] লেখা ছিলো।

প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যুক্ত না হয়েও রাজনীতির মাঠ পর্যায়ের একজন কর্মীর মতোই কাজ করতেন তিনি। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াতের দেশব্যাপী তান্ডব, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর এবং সর্বোপরি ২০০৭-এ ওয়ান ইলেভেন সময় শেখ হাসিনার গ্রেফতার আন্দোলনে দল তার নিরলস সংগ্রাম নানাভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তখন রাজনৈতিক কর্মী নয়, সংবাদকর্মী হিসেবে তার পাশে আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো।

সীমিত আয় দিয়েও যে কীভাবে স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন করা যায়; এই বিষয়টি আমরা বিচিত্রার অনেকেই তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম। সাদামাটা জীবন যে কতোটা আনন্দের হতে পারে বেবী আপাকে দেখে সেটা উপলব্ধি করেছি। জীবনে যতো বেশি চাহিদা থাকবে জীবন তত জটিল হবে। সুতরাং চাহিদাকে কমিয়ে এনে জীবনকে আরো স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলা। বেবী আপার কাছ থেকে আমি এবং আমার মতো অনেকেই এ শিক্ষা পেয়েছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এতো কাছের আপনজন হয়েও তিনি রিকশায় চড়তেন। একটা গাড়ি কেনার সাধ বা সাধ্য তখন তার ছিলো না।

কর্মময় জীবনই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সাংবাদিক-সাহিত্যিক বেবী মওদুদ তার স্বীয় কর্মের মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। তবে সাংবাদিক মহলে বেবী আপাকে নিয়ে উপলব্ধি ভালো-মন্দ মিলিয়েই। মনের দিক থেকে সহজ-সরল হলেও প্রচণ্ড অভিমানী ছিলেন তিনি। অনেক ক্ষেত্রে তা ক্ষণস্থায়ী হলেও অন্যায় বা অনিয়মের সঙ্গে আপস করতেন না কখনো। সে কারণে অনেকের বিরাগভাজনও ছিলেন। তবে আমি কাছ থেকে যে বেবী আপাকে দেখেছি সেই আপা একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও শ্রদ্ধাশীল আদর্শ। বেবী আপা আমাদের যা শিখিয়েছেন তা আমরা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা কখনোই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তার কাছে শিখেছি। আমার কাছে তার স্মৃতি আজও অম্লান। আজ তার ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রার্থনা যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।

লেখক : দুলাল আচার্য, সহকারী সম্পাদক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

 

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044841766357422