ব্রেইল : দৃষ্টিপ্রতিবদ্ধীদের শিক্ষার আলো - দৈনিকশিক্ষা

ব্রেইল : দৃষ্টিপ্রতিবদ্ধীদের শিক্ষার আলো

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ |

আজ ৪ জানুয়ারি বিশ্ব ব্রেইল দিবস৷ দিবসটি অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের শিক্ষার সুযোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই শিক্ষা গ্রহণ করছে তারা যে পদ্ধতিতে সেটাকে আমরা ব্রেইল পদ্ধতি বলি।

ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। তারাও প্রমাণ করতে পারছেন তাদের মেধা এবং দক্ষতা। তাই আজ প্রতিটি দেশে বিশ্ব ব্রেইল দিবস পালিত হচ্ছে। এই ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন লুইস ব্রেইল। ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে প্যারিসের কাছে কুপভেরি নামক একটি ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার এই মহান সুদূরপ্রসারী আবিষ্কারের ফলে তাকে সম্মান জানানোর জন্য তার জন্মদিনে ব্রেইল দিবস পালিত হয়। ব্রেইল পদ্ধতিতে ছয়টি ডট দিয়ে অক্ষর, সংখ্যা, চিহ্ন ইত্যাদিকে সূচিত করা হয়। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই উন্নীত বা উত্তর বিন্দুর ওপর আঙুল বুলিয়ে নকশা অনুযায়ী অক্ষরগুলো অনুধাবন করে। এই পদ্ধতি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য যে কতোটা আশীর্বাদস্বরূপ সেটা আমরা সাধারণ মানুষ হয়তো উপলব্ধি করতে পারি না।

ব্রেইল পদ্ধতির নাম এখন প্রায় সবাই জানেন। এটি অন্ধদের পড়ার বিশেষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে পৃষ্ঠার ওপর সাজানো কিছু ডট বা বিন্দু হাত দিয়ে ধরে ধরে অন্ধ ব্যক্তি বুঝতে পারেন, কী লেখা আছে। সুপার মার্কেটের বিভিন্ন পণ্যের গায়ে, এটিএম বুথের কি-প্যাডে বা এ রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জায়গায় ব্রেইল অক্ষর বা সেল চোখে পড়ে।

১৮০০ শতকের কথা। ফ্রেঞ্চ আর্টিলারি অফিসার চার্লস বারবিয়ের কেবল ১২টি বিন্দু বারবার ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদানের একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। মানে, ১২টা বিন্দুকে বিভিন্ন বিন্যাসে সাজিয়ে প্রতিটা অক্ষর বা সংখ্যা লেখা যাবে। এর নাম ছিল ‘নাইট রাইটিং’। রাতের অন্ধকারে বাতি না জ্বেলেই সৈন্যরা যেন তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু এই পদ্ধতির একটা বড় সমস্যা ছিলো। ১২টা বিন্দু একই সঙ্গে ধরে অনুভব করাটা বেশ কঠিন। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে বিন্দুগুলোর বিন্যাসের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান করে ১২ বছর বয়সী এক কিশোর—লুই ব্রেইল। 

প্যারিসের রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইউথসে বারবিয়ের অন্ধদের জন্য ‘নাইট রাইটিং’ পদ্ধতি ব্যবহারের উপযোগিতা নিয়ে কথা বলেন। ব্রেইল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভাবলেন, প্রতিটা অক্ষরকে ১২টার বদলে ৬টা বিন্দু দিয়েই কি প্রকাশ করা সম্ভব? যেই ভাবা, সেই কাজ। 

৬টা বিন্দুকে ২টি কলাম এবং ৩টি সারিতে বিন্যস্ত করলেন ব্রেইল। এদের ‘সেল’ বলা হয়। তারপর বিভিন্ন অক্ষর বা সংখ্যার জন্য বিন্দুগুলোকে বিভিন্ন বিন্যাসে বিন্যস্ত করলেন। যেমন ইংরেজি a বোঝানোর জন্য ৬ বিন্দুর সেলের একেবারে বাঁয়ের বিন্দুটি কেবল উঁচু হয়ে থাকবে। 

স্বাভাবিক ইংরেজি বাক্যের মতোই, ব্রেইল পদ্ধতিতেও প্রতিটা অক্ষর বা সেলকে আলাদা করে যেমন পড়া যায়, তেমনি কয়েকটি সেল একসঙ্গে মিলে তৈরি করতে পারে শব্দ। দুটো শব্দের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা থাকে, যাতে বোঝা যায়, দুটো শব্দ আলাদা।

ব্রেইল লেখার জন্য মোটা কাগজে সরু মাথার কিছু দিয়ে দাবিয়ে দাবিয়ে লিখতে হয়। সমস্যা হলো, লেখাটা লিখতে হয় উল্টো করে। কারণ, পড়ার সময় কোন বিন্দুটা উঠে আছে, সেটা ধরে বোঝা লাগে। তাই উল্টো করে লিখে পৃষ্ঠা উল্টে দিলে লেখাটা পড়ার যোগ্য হয়। এখন এভাবে হাতে হাতে আর না লিখে ব্রেইলরাইটার দিয়ে লেখা হয়। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা বইও বাজারে পাওয়া যায়।

তবে আর সবকিছুর মতোই ব্রেইলের জগতেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। প্রযুক্তির ওপর ভর করে কাগজের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের যন্ত্র। এর নাম রিফ্রেশেবল ব্রেইল। এগুলো আসলে বৈদ্যুতিক ব্রেইল রিডার। ডিজিটাল টেক্সট বা লেখা পড়ে নিয়ে তাকে ব্রেইলে রূপান্তর করে যন্ত্রটি। তারপর যন্ত্রের এক পাশের সারিবদ্ধ সেলগুলোতে ব্রেইল অক্ষরে ফুটে উঠতে থাকে লেখাটা। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, একসঙ্গে কেবল এক লাইন লেখাই সে দেখাতে পারে। আর, এদের দামও অনেক বেশি।

মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ব্রেইল ট্যাবলেট বানানোর জন্য কাজ করছেন। এর মধ্যকার সেলগুলোতে বিভিন্ন বর্ণ দেখানোর জন্য বাতাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন তারা। বাতাসের পরিমাণ কম-বেশির মাধ্যমে সেলের মধ্যকার বর্ণগুলো পরিবর্তিত হবে। প্রজেক্টটির নাম দেওয়া হয়েছে হলি ব্রেইল!

ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, পৃথিবীতে বর্তমানে ৩৬ মিলিয়ন অন্ধ মানুষ আছেন। সে তুলনায় খুব বেশি মানুষ ব্রেইল ব্যবহার করেন না। বর্তমানে বেশির ভাগ জায়গায় ব্রেইলের বিকল্প হিসেবে অডিও ব্যবহার করা হয়।

মানুষ তার নিজের জীবন থেকেই কোনো কিছুর গুরুত্ব উপলব্ধি করে। লুইস ব্রেইলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিন বছর বয়সে লুইস ব্রেইল অন্ধ হয়ে যান। দৃষ্টিহীনতার কারণে তার জীবন থেমে থাকেনি। পড়াশোনার জন্য তিনি ভর্তি হলেন প্যারিসের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি বিশেষ স্কুলে। একদিন তিনি জানতে পারলেন অ্যালফাবেট কোডের কথা। ফরাসি সৈন্য বাহিনীর অফিসাররা সৈন্যদের সঙ্গে রাতে কথা বলার সময় শত্রুপক্ষের নিশানা থেকে বাঁচতে এই কোডে কথা বলতেন। এই অ্যালফাবেট কোড বেশ কিছু বিন্দু আর ছোট লাইনের সমষ্টি যেগুলো পাতার ওপর একটু উঁচু করে খোদাই করা হতো যাতে আঙুল স্পর্শ করলে সেগুলো পড়া যায়। ব্রেইলের কাছে এই পদ্ধতি অনেক ভালো লাগে এবং তার মাথায় অন্ধদের শিক্ষা দেয়ার নতুন উপায় আসে।

২০ বছর বয়সে ব্রেইল অন্যান্য অন্ধ ব্যক্তিকে শিক্ষা দিতে অগ্রসর হন। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথম ব্রেইল পদ্ধতির বই প্রকাশ করেন। তবে তখনকার সময়ে এই পদ্ধতিতে অন্ধদের শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটি খুব একটা প্রচলিত হয়নি। তবে বর্তমানে এই পদ্ধতি অনেক কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। অন্ধ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহারকারীরা রেফ্রেসবল ব্রেইল ডিসপ্লে ব্যবহার করার মাধ্যমে কম্পিউটারের পর্দা ও অন্যান্য সমর্থনযোগ্য ডিভাইস পড়তে পারেন।

লুইস ব্রেইলের এই আবিষ্কার আজ পুরো পৃথিবীর কাছে স্মরণীয়। অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কাছে নতুন এক দ্বারের উন্মোচন ঘটেছে। তারাও শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে অন্যদের মতো। বর্তমানে বিভিন্ন ভাষায় এই ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করা হয়েছে।

পরিশেষে বলতে চাই, একসময় অন্ধত্বের হার ছিলো ১ দশমিক ৪৫ শতাংশ। কিন্তু সর্বশেষ জরিপে সেটা কমে দশমিক ৬৯ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ এখন ১০০ জনে ১ জনেরও কম বা ১ হাজার জনে ৭ জন অন্ধত্বের শিকার। সে হিসেবে বর্তমানে দেশে জনসংখ্যার ১২ লাখ মানুষ অন্ধ। অন্যদিকে, ৩ শতাংশ বা ৫১ লাখ মানুষ ক্ষীণদৃষ্টির শিকার। অবশ্য দৃষ্টিজনিত অন্য সমস্যা রয়েই গেছে। তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দৃষ্টিজনিত মূল সমস্যা ছানি, গ্লুকোমা ও রেটিনার সমস্যা। চশমাজনিত দৃষ্টির সমস্যা এখন প্রায় ১০ শতাংশ বা ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের। চোখের ছানি সমস্যায় ভুগছেন ৪-৫ শতাংশ বা ৮৫ লাখ মানুষ ও চোখের গ্লুকোমাজনিত সমস্যার শিকার ১-২ শতাংশ বা ৩৪ লাখ মানুষ।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষ যেমন অন্যান্য অধিকার থেকে বঞ্চিত, ঠিক তেমনি প্রযুক্তি সহায়ক বিভিন্ন ডিভাইস থেকেও অনেকাংশে বঞ্চিত। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এখন শুধু সাদাছড়ি আর হুইলচেয়ার নয়, প্রয়োজন তাদের হাতে কম্পিউটার, ল্যাপটপ কিংবা স্মার্টফোন। এই অধিকারের কথা জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ’-এর ৯ ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩’-এ উল্লেখ রয়েছে যে সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সংস্থা কর্তৃক গণমাধ্যম, ইন্টারনেটসহ অন্যান্যভাবে সর্বসাধারণের জন্য প্রচারিত সব তথ্য ও সেবা, যথোপযুক্ত ব্যবহার উপযোগী পদ্ধতি ও প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রাপ্তির নিমিত্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা এবং এ উপলক্ষে তথ্য ও সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করা।’ দেশে বর্তমানে ২৪ হাজারের মতো ওয়েবসাইট আছে, তবু একটি ওয়েবসাইটও পরিপূর্ণভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যবহার উপযোগী নয়। তবে আশার কথা, সরকার এ ধরনের একটি নীতিমালা প্রণয়নের চিন্তা করছে।

তবে বর্তমান সরকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যা শিক্ষাব্যবস্থা, যোগাযোগ ও চলাচলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার আলোর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা পৃথিবীটাকে দেখছে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074470043182373