ভাষার ভিত দুর্বল হওয়া আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম হুমকি - দৈনিকশিক্ষা

ভাষার ভিত দুর্বল হওয়া আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম হুমকি

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ইদানীং অনেক বাঙালিকেই দেখা যায় বেশ ভালো করে বাংলা পড়তে ও লিখতে জানা সত্ত্বেও ইংরেজি অক্ষরে বাংলা লেখেন! বিশেষ করে মোবাইল ফোন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ই-মেইলে খুদেবার্তা পাঠান, যা 'ব্যাংলিশ' ফ্যাশনে লেখা। অর্থাৎ ইংরেজি অক্ষরে লেখা বাংলা শব্দ ও বাক্য! আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে বিকৃত করার এ অপচেষ্টা রোধকল্পে নীরব প্রতিবাদ হিসেবে আসুন, সবাই তাদের 'ব্যাংলিশ'-এর উত্তরে 'ইংব্যাং' কায়দায় অর্থাৎ বাংলা অক্ষরে ইংরেজি লিখে জবাব দিই- এতে যদি তাদের টনক নড়ে! সোমবার (১ মার্চ) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, কিছু ব্যাংলিশ বনাম ইংব্যাং লেখার উদাহরণ দিই। যেমন ধরুন কেউ লিখলেন-ব্যাংলিশ: ki kobor, Kmon asen? ইংব্যাং:আই অ্যাম ফাইন। থ্যাংক ইউ। হাউ আর ইউ? দেখতে ও পড়তে খুব বেমানান লাগছে, কষ্ট হচ্ছে? একটু রাগও হচ্ছে? কী অদ্ভুত, তাই না? এভাবেই হয়তো তাদেরকে বোঝানো সম্ভব, ইংরেজিতে বাংলা লেখাও ঠিক এমনই বেখাপ্পা আর হাস্যকর একটা কাজ। আজকাল অনেকেই বাংলা ভাষার বিকৃতি করছেন- বুঝে বা না বুঝে। তাতে নিজ মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির যে কত সুদূরপ্রসারী ক্ষতি হচ্ছে, এটা হয়তো তাদের বোধেরও অতীত। তাই তাদের মতো ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্নদের চোখে আঙুল দিয়ে ওরা কী করছে তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এই 'ইংব্যাং' লেখা হতে পারে একটা নীরব কিন্তু কার্যকর প্রতিবাদী আন্দোলন।

ভাববেন না, এটা করতে আপনার ভালো লাগবে! বরং আরও বেশি অস্বস্তিকর লাগবে ইংব্যাং লিখতে। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে এ ক্ষুদ্র কষ্টটুকু না হয় করলাম। আমরা অত্যন্ত ভদ্রভাবে নীরবে এ অধ্যবসায় চালিয়ে যেতে পারি। সামাজিক মাধ্যমগুলো হতে পারে এ সামাজিক আন্দোলনের শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম। মাঝেমধ্যে তাদের মতো কিছু ইংরেজি অক্ষর বা শব্দকেও আমাদের ভাষায় আমাদের মতো লিখব। এতে তারা বুঝতে পারবে, প্রত্যেক ভাষারই কিছু নিজস্ব স্বর, ধ্বনি, অক্ষর ও শব্দ এমনকি প্রকাশ ভঙ্গি আছে, যাকে সেই ভাষা অনুযায়ীই বলতে ও লিখতে হবে।

ব্রিটিশদের হয়তো সেই বোধটুকু ছিল না বলেই ঢাকাকে 'ডাক্কা', চট্টগ্রামকে 'চিটাগং' ইত্যাদি বলতে পেরেছে। আমরা এত বছর পর এসব বিকৃতির কিছু কিছু শুদ্ধ করেছি। তার পরও রয়ে গেছে অনেক কিছু। এমনকি খোদ বাংলাকে 'বেঙ্গল', আর বাঙালিকে 'বেঙ্গলি' রূপে এখনও বলা ও লেখা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্রিটিশরা না হয় ভিন্নভাষী ছিল, কিন্তু আমাদের মাতৃভাষাকে আমাদেরই মতো বাংলাভাষী কতিপয় বাঙালি কেন এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অপপ্রয়োগ করছে? একটু ভেবে দেখলেই এর পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রথমত, বাংলা টাইপিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সহজ বাংলা কিবোর্ড ও সফটওয়্যারের অভাব। কিছু কিবোর্ড ও সফটওয়্যায়ের ব্যবহার প্রচলিত থাকলেও সেগুলোর ব্যবহার পদ্ধতি সহজ নয়। বিশেষ করে মোবাইল ফোনে যেসব সফটওয়্যার ব্যবহার হচ্ছে, তার প্রায় সবই অফিসিয়াল কাজ বা ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহূত পিসি ও ল্যাপটপে ব্যবহূত হয় না বা করা যায় না। এমনকি যারা পেশাগতভাবে টাইপিং শেখেন, তারাও মোবাইল ফোনে 'মুনির' বা 'বিজয়' ব্যবহার করতে পারেন না। আর যারা মোবাইল ফোনের অ্যাপ'-এ বাংলা টাইপিং শিখেছেন, তারা সেটি কোনো কম্পিউটার বা অফিসিয়াল কাজে ব্যবহার করতে পারেন না! এর সমাধানে আইটি সফটওয়্যার জিনিয়াসদের এগিয়ে আসা জরুরি। আমাদের তরুণরা উন্নতমানের বিভিন্ন সফটওয়্যার তৈরি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কৃত হচ্ছে। কিন্তু নিজ মাতৃভাষা টাইপিংয়ে ব্যবহারের জন্য সহজ কোনো সফটওয়্যার তৈরিতে এখন পর্যন্ত কেউ খুব বেশি আগ্রহ দেখায়নি। সরকার কিছু নীতিমালার মাধ্যমে বাংলা টাইপিংয়ের জন্য দু-একটি সফটওয়্যার, যা সহজে কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনে ব্যবহার করা যায়, তা সুনির্দিষ্ট করে দিতে পারে। যেসব কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনে এসব বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহার করা যাবে না, আইনের মাধ্যমে সেগুলোর আমদানি, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও চাই নতুন প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে। বর্তমান সরকার এ ব্যাপারে শতভাগ সংকল্পবদ্ধ। ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ শুধু কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নয়; জাতীয় এজেন্ডা। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ, ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন, ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে 'রূপকল্প ২০৪১', সর্বোপরি ২১০০ সালের মধ্যে 'ডেল্টা প্ল্যান' বাস্তবায়ন; এগুলো আমাদের জাতীয় উন্নয়নে অপরিহার্য মাইলফলক। আর এসব লক্ষ্য একে একে অর্জনে বাংলা ভাষাকে আধুনিক প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে উন্নীত করতে হবে।


তৃতীয়ত, বাংলা আমাদের ভাষা বলেই আমরা বিশ্বদরবারে বাঙালি বলে পরিচিত, আমাদের দেশ বাংলাদেশ। আমরাই একমাত্র দেশ ও জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আজ বিশ্বজুড়ে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে উদযাপিত হচ্ছে স্বমহিমায়। বায়ান্নর হাত ধরেই এসেছে আমাদের একাত্তরের স্বাধীনতা। আমাদের পূর্বপুরুষ লাখো শহীদের অমর আত্মত্যাগের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পরবর্তী প্রজন্ম হিসেবে আমাদের অন্যতম নৈতিক গুরুদায়িত্ব। তাই এ দেশ এ জাতির মৌলিক ভিত্তি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পরিশুদ্ধ চর্চা, প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকায়ন এবং টেকসই যুগোপযোগীকরণের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ রোধ না করতে পারলে আমাদের যে কোনো অভীষ্ট জাতীয় লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। ভাষার ভিত দুর্বল হওয়া আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চরম হুমকি। কাজেই, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্র তথা বাঙালি জাতীয় নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের জন্য বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা ও উন্নত করার কোনো বিকল্প নেই।

চতুর্থত, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা মৌলিক। মৌলিক বলতে প্রথম ধাপের বিদ্যালয় ও শিক্ষককে দিয়ে শুরুটা বোঝানো হচ্ছে। বলা হয়ে থাকে, একটি শিশুর জীবনে প্রথম স্কুল তার পরিবার, প্রথম শিক্ষক তার মা। মূলত মা-ই একটি শিশুর মনে বড় হয়ে 'মানুষ' হওয়ার দোষ-গুণ-অভ্যাসের গোড়াপত্তন করে দেন। কিন্তু মা নিজেই যদি 'কুশিক্ষিত' হন, তাহলে সেই কুশিক্ষার প্রভাব নিয়েই সন্তান বেড়ে উঠবে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে 'অশিক্ষিত' মায়ের চেয়ে এ জাতীয় 'কুশিক্ষিত' মা অনেক বেশি ক্ষতিকর। দুঃখজনক হলো সম্প্রতি কিছু নব্য বড়লোক বা ধনী পরিবার সন্তানদের উন্নত লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বিদেশে পাঠাচ্ছেন। তারা সরাসরি সন্তানদের ব্যাংলিশ ব্যবহারে উৎসাহিত করেন। আর যদি সন্তান ব্যাংলিশে কথা বলে আর লেখে, বাবা-মা খুশিতে আরও গদগদ হয়ে ভাবেন, 'হাউ স্মার্ট!' এখানেই বড় সমস্যা! একজন শিক্ষিত বাঙালি হয়েও বুঝি না- ওরা কী লেখে, কী বলে! এরূপ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আবার প্রবাসী। তারা তাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা বা সংস্কৃতি শেখাতে ব্যর্থ। তাদের অধিকাংশই তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে 'উচ্চশিক্ষিত'; সন্তানরা কেন বাংলা বলতে বা লিখতে-পড়তে পারে না, তার পক্ষে তারা অনেক যুক্তি দেখাবেন। কিন্তু তার প্রতিবেশী পরিবারের ছেলেটি বা মেয়েটি যে একই সামাজিক পরিস্থিতিতে থেকেও বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করে চলেছে প্রতিদিন; সেটির বিপক্ষে যুক্তি দিতে পারবেন না! পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসবাসরত এমন অনেক পরিবারকে চিনি যাদের সন্তানরা শতভাগ বাঙালিত্বকে ধারণ করেই সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক অবস্থায় ভিনদেশে সুন্দর জীবন যাপন করছে। সুতরাং, এই 'ব্যাংলিশ' বা ইংরেজিতে বাংলা বলা ও লেখা আপাতদৃষ্টিতে একটি লঘু বা তুচ্ছ বিষয় মনে হলেও এর পেছনের কারণগুলো ও তার প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী। আর তাই এ সমস্যা সমাধানে প্রস্তাবিত 'ইংব্যাং' বা বাংলায় ইংরেজি বলা বা লেখার সামাজিক আন্দোলন আজ বাংলা ও বাংলাদেশের বৃহত্তর স্বার্থে অত্যন্ত জরুরি।

মূলকথা একটিই- আমরা ক'জন মনে-প্রাণে 'হৃদয়ে বাংলাদেশ'কে ধারণ করেছি? যারা পারিনি, তারা আজ জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সমূহ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে চলেছি। যেমন এই তথাকথিত 'শিক্ষিত', 'বড়লোক' বাবা-মা ও সন্তানেরা। এদের সচেতন করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। ব্যক্তি উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারি পদক্ষেপ এখানে জরুরি। আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্মের হাতে মাতৃভাষার এমন বিকৃতি দেখে নিজেকে কষ্টে আর রাগে ধিক্কার দিই, ভাবি- এ আমাদেরই ব্যর্থতা। যেভাবেই হোক এ অবক্ষয় রোধ করতেই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে- বায়ান্ন সালে যদি আমাদের পূর্বপুরুষরা এ ভাষাকে রক্ষার জন্য প্রাণ দিতে পারেন, আমরা কেন এসব বিকৃতি ও অপব্যবহার রোধে এখন সামাজিক আন্দোলন করতে পারব না।

 

লেখক : এম সানাউল হক, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল ।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045149326324463