রাজধানীর স্বনামধন্য একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র অমি (ছদ্মনাম)। করোনা মহামারির আগে স্কুলে যাওয়ার জন্য উৎসাহী হলেও এখন আর স্কুলে যেতে চাচ্ছেন না। পরীক্ষা নিয়েও অনিহা তার। দৈনিক আমাদের বার্তাকে তিনি বলেন, এখন আর আগের মত ক্লাসে যেতে ভালো লাগে না। ছুটির আগে যেমনটি ছিলো তেমনটি আর নেই। ছুটির সময়ই ভালো ছিলো। পরীক্ষা ছিলো না।
অমির সঙ্গে যেদিন কথা হয়, তার পরদিনই ছিলো গণিত পরীক্ষা। স্কুল-পরীক্ষা কেনো কেনো ভালো লাগছে না জানতে চাইলে তার উত্তর, কেনো ভালো লাগে না তা জানি না, কিন্তু ভালো লাগে না। কোনো কিছুই আগের মত নেই, বন্ধুরাও না। বাসায়ও ভালো লাগে না, ক্লাসেও না। টিচাররাও আগের মত নেই। ক্লাসে বকা দেন। সেদিন বই আনতে ভুলে যাওয়ায় টিচার স্কেল দিয়ে দুটো বাড়ি দিয়েছেন। তাতে মন আরও বেশি খারাপ।
ওই ছাত্রের শিক্ষক মা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, আমার ছেলে করোনা মহামারি শুরুর আগে নিয়মিত স্কুলে যেতো। এখন পড়তে বসতেও চায় না।
শুধু ওই শিক্ষার্থীই নয়, সারাদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মনজগতে করোনা মহামারির পর পরিবর্তন এসেছে। দুই বছর পর ক্লাসে ফেরা শিশুদের মনোযোগ আর ক্লাসে থাকছে না। তাই পাঠদান করাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষকদের। তারা বলছেন, শিক্ষার্থীরা প্রায় দুই বছর ঘরে বসে থেকে শৃঙ্খলা বোধ ভুলে যাচ্ছে, তাদের ক্লাসে মনোযোগী করা যাচ্ছে না।
শিক্ষকদের অনেকে বলছেন, করোনা মহামরির পর ক্লাসে ফেরা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণি পরীক্ষা ও স্কুলের পরীক্ষাতেও নকলমুখী হচ্ছে। আগে শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলোকে প্রচলিত দৃষ্টিতে অপরাধ মনে করতো সেটিকে তারা এখন আর আগের মত গুরুত্ব দিচ্ছে না।
বিষয়টি নিয়ে অভিভাবকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই বছর ঘরবন্দি থাকার পর শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে। একবারেই তারা আগের মত হয়ে যাবে সে আশা করা ঠিক না। শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করতে স্কুলগুলোর জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দিয়ে স্কুলে স্কুলে কাউন্সিলিং করা জরুরি। এতে তাদের মানসিক সমস্য অনেকাংশে কমে যাবে।
তবে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের বিষয়টি এক দশক ধরে আলোচনায় থাকলেও তা নিয়ে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও আগের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একাধিকবার মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের কথা বললেও তা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে কথা হয় রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের বসুন্ধরা শাখার সপ্তম শ্রেণির একটি শাখার শ্রেণি শিক্ষকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা ক্লাসে মনোযোগী না। সবসময় হইচই, কথা বলা। ফোন নিয়ে স্কুলে আসছে। ক্লাসে বসে কথা বলছে। ক্লাসের চেয়ে স্মার্ট ফোন অনেকের কাছে বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে। ক্লাস টেস্টে নকল করছে, পরীক্ষায় নকল করছে। তারা কোনো অপরাধকে অপরাধ মনে করছে না। ওইদিন এক ছাত্রী বললো, আমি বই দেখে লিখেছি, কেনো কম নম্বর পেলাম। এই হলো অবস্থা।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলের নবম শ্রেণির একছাত্র অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায় নকল করে ধরা পড়ার পর স্কুল থেকে বাড়ী না ফিরে নিরুদ্দেশ। দুইদিন পর তাকে স্কুলড্রেস পরা অবস্থায় বেনাপোল সীমান্ত এলাকা থেকে আটক করে পুলিশ। পরে অভিভাবকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এমন আচরণে হতবাক সবাই।
রাজধানীর ইস্কাটন এলাকার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির একাধিক ছাত্র ফাইনাল পরীক্ষায় নকল করেছে। এতেও অবাক হয়েছেন মিশনারী পরিচালিত স্কুলটির শিক্ষকরা।
অভিজ্ঞ শিক্ষকরা বলছেন, করোনাকালে গাইডেন্সের অভাবে তাদের জীবন খাপছাড়া হয়ে গেছে। গত দুই বছরে অনেক শিক্ষার্থী বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করেছে। তাই তাদের আচরণের বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
রাজধানীর বিটিসিএল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদের নেতা মজিবুর রহমান বাবুল দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, তারা বাড়ির কাজ ঠিকমত করছে না। শিক্ষকদের না মানার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সহপাঠীদের সঙ্গে সহনশীল আচরণ না করে ঝগড়ার প্রবণতা বেড়েছে। শিক্ষার্থী-শিক্ষার্থী হাতাহাতি লেগে যাচ্ছে সহজেই। শিক্ষক এক শ্রেণি থেকে অন্য শ্রেণিতে যাওয়ার সময়টুকুতেই বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। এসেম্বলিতে, প্রতি ক্লাস শুরু করার আগে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কিছু অভিভাবক সন্তানের নেতিবাচক দিকগুলো স্বীকার করতে চাইছেন না।
এসব জটিলতা নিরসনে স্কুল-স্কুলে বাচ্চাদের জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন। দৈনিক আমাদের বার্তাকে তিনি বলেন, শিশুদের দুই বছর পর ক্লাসে ফিরিয়ে আনার পর তারা আগের মত আচরণ করবে সেটি চিন্তা করাও উচিত না। দুই বছর বন্দি থাকার পর তাদের মধ্যে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। যথাযথ কাউন্সিলিং পেলে তাদের সেসব জটিলতা কেটে যাবে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়া হোক।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি স্কুলের জন্য একজন মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দিতে হবে সে রকম কথা না। কিন্তু এলাকাভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। যিনি অন্তত সপ্তাহে একদিন স্কুলে স্কুলে গিয়ে ওই স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। এতে করে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো দূর হবে। বাচ্চারা ভুল করবেই, সেজন্য তাদের ওপর চড়াও না হয়ে তাদের বোঝাতে হবে। বিষয়গুলো শিক্ষকদের বুঝতে হবে।
স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের বিষয়টি যেমন ঝুলে আছে, তেমনি ঝুলে আছে শিক্ষার্থীদের কাউন্সিলিং নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টিও।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। মাঝখানে করোনার কারণে পিছিয়ে পড়েছি। এখন আমরা ৬৪টি জেলায় একজন করে কাউন্সিলর বা মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দেয়ার কাজটি শুরু করেছি। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত দুজন শিক্ষককে কাউন্সেলিং বিষয়ে শিক্ষা দিতে পারে। আমরা আশা করছি শিগগিরই দুই লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিতে পারবো। যাতে এসব ক্ষেত্রে যে কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারেন শিক্ষকরা।
কিন্তু মন্ত্রীর ওই ঘোষণার দুই বছর পরও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি। এর আগে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনিও ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেননি।