এবার এসএসসিতে সাফল্য পেয়েছে জলে ভাসা মান্তা সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থী ইউসুফ। তার ফলাফলে খুশী শিক্ষক, সহপাঠিসহ পটুয়াখালীর বাউফলের শৌলা এলাকার বগীর খালে নৌকায় অবস্থান করা পুরো মান্তা সম্প্রদায়। ইউসুফই এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম এসএসসি গ্রাজুয়েট। বরিশাল বোর্ডের অধীন কর্পূরকাঠী ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। উপকূলীয় সাগর মোহনার বিভিন্ন নদী-জলে ভাসা এক পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি মান্তা (ভাসান) সম্প্রদায়ের ছোট্ট এক নৌকায় জন্মের পর জল-জালের বাঁধা পেড়িয়ে এসএসসির ফলাফলে সাফল্য ছিনিয়ে নিয়েছে সে। এবার উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখছে নানা প্রতিকূলতায় স্বাভাবিক জীবনের ছোঁয়া না পাওয়া জলে ভাসা এই শিক্ষার্থী ইউসুফ।
দৈনিক শিক্ষা ও দৈনিক আমাদের বার্তাকে ইউসুফ জানায়, ‘আবু ইউসুফ স্থানীয় ও সহপাঠিদের কারো কারো কাছে অভি নামেও পরিচিত। নৌকায় নৌকায় উপকূলীয় নদ-নদীতে ভেসে বেড়ানো আর জাল-জলের জীবন তার। রোগে-শোকে কারত বাবা ফরিদ সরদার (৫১)। বগীর খালের তুলাতলার ঘাটে বাঁধা নৌকা ছেড়ে নদীতে মাছ শিকারে গিয়ে ঠান্ডা লেগে বুকে কফ জমে আর সেরে ওঠেননি মা রুনু লায়না। গত জুন মাসের ৪ তারিখে ৪৬ বছর বয়সে পাড়ি জমায় ওপারে। বিয়ের পরে পৃথক নৌকায় সংসার পাতা হালিমা, বাচ্চু সরদার আর ডালিমা নামে আরো বড় তিন ভাই বোন আছে তার। নদীর ঢেউয়ে নৌকায় ভাসিয়ে কিংবা জাল ফেলে মাছ ধরার অবসরে নৌকার গলুইয়ে বসে বসে ক্লাসের বই পড়ার মতো অদম্য ইচ্ছা শক্তিই তার এসএসসি পাশের মুল মন্ত্র।
তবে সমাজের দলিত, অবহেলিত কিংবা অধিকার বঞ্চিত মানতা সমপ্রদায়ে জন্ম নেয়ায় বহুবিধ প্রতিকুলতায় ভরা জীবন যেন তার। মাকে হারিয়ে তা হয়েছে আরো বিবর্ণ। মারা যাওয়ার আগে মা রুনু লায়নার কাছ থেকে জেনেছে কোন এক সময়ের বন্যার পরে সর্বশান্ত হয়ে বরিশালের শ্রীপুর এলাকা থেকে নৌকা ভাসা জীবন বেছে নেয় পূর্বপুরুষরা। আর শ্রীপুর এলাকার নাম না জানা এক চরে নোঙর করা অবস্থায় নৌকাতেই জন্ম হয় তার (ইউসুফ)। আর ওই জন্ম থেকেই জলে ভাসা জীবনের শুরু তার। একদিন বড় ভাই বাচ্চু সরদার ও বোন ডালিমার সঙ্গে নদীতে জাল ফেলতে গেলে ভুতুম চর নামে এক চরে রান্নার জন্য গাছের শুকনো ডাল কুঁড়াতে পাঠিয়ে ফিরতে দেঁড়ি হওয়ায় ডাকাতের ভয়ে অন্ধকারে তাকে সেখানে ফেলে রেখেই নৌকা চালিয়ে বোনকে নিয়ে বড় ভাইয়ের চলে আসার মতো লোমহর্ষক ঘটনাও আছে তার জীবনে। আছে নৌকা আর জাল-জলের জীবন নিয়ে পৃথিবীতে আসায় বিভিন্ন সময়ে নদীর চরায় কচুরিপানার নীচে নতুন শাড়ি কাপড়ে জড়ানো লাশ ভাসতে দেখে আতকে ওঠার মতো দুর্বিসহ নানা স্মৃতি। তবে দেশের নাগরীক হয়েও ডাঙায় আর অধিকার বঞ্চিত হয়ে নৌকায় জলে ভাসা জীবনের বৈষম্য দেখে পড়াশুনায় আগ্রহ বাড়ে তার। এক ধরণের যাযাবর জীবন হয়ায় সঠিক যেন ঠিকানাই নেই তার। সাগর মোহনার বিভিন্ন স্থানে নৌকা ভাসিয়ে মাছ শিকার করে বেড়ালেও দীর্ঘদিন থেকে বগী তুলাতলা এলাকায় তাদের নৌকার অবস্থান দেখে আসছে সে।
ইউসুফ জানায়, এ বছর এসএসসিতে জিপিএ- ৫ পেয়েছে সে। একই বিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপসহ জেএসসিতে জিপিএ-৫ এবং পিএসসিতে ৮৬ নম্বর কর্পূরকাঠী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকেও স্কলারশিপসহ জিপিএ-৫ পেয়েছিল সে। তবে শিক্ষায় নিরন্তর অবদান তার শিক্ষকদের। জহুরুল ইসলাম নামে তার প্রাইমারি স্কুলের এক শিক্ষক প্রথমে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। লজিং কেটেছে ৮ম থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত একে নৈশ স্কুলের আমিরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষকের বাসায়। শিক্ষদের কেউ কেউ ফ্রি পড়ায়। কেই বই কিনে দেয়। কেই দেয় জামা-কাপড়। প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি ঘোষ স্কুলে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন।
মায়ের অবর্তমানে পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়ে আনন্দের পরিবর্তে চোখে জল আসে তার। মা মারা যাওয়া আর করোনার কারণে আরো বেশি অভাব লাগে রোগ-শোকে কাতর বাবা ফরিদ সরদারের নৌকায়। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে তাকে নিয়ে মিডিয়ায় এক রিপোর্ট প্রকাশের সূত্রে পরিচয়ে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদিতে অলিউল ইসলাম মুকুল নামে এক মোটরপার্টস বিক্রেতার দোকানের কর্মচারি হিসেবে কাজ নেয়। পেট চালাতে ও বাবাকে সহোযোগিতা করতে পার্টটাইম কাজও নেয় সে কেয়ার জেনারেল হাসপাতাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানে এসএসসির রেজাল্ট পেয়ে মোবাইলফোনে জানাতে গিয়ে ইউসুফ কান্নায় ভেঙে পড়ে তার শিক্ষক ও সহপাঠিদের সঙ্গে। দৈনিক শিক্ষা ও আমাদের বার্তাকে ইউসুফ জানায়, মা মারা যাওয়ায় মরা শুকনা আমি। মরে গেছে আমার সব অনন্দ অনুভূতিও। তবে মনের উচ্চ শিক্ষার লালিত স্বপ্নের কথাও ব্যক্ত করে সে।
ইউসুফ দৈনিক শিক্ষা ও আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘জন্ম, বিয়ে, জীবন-জীবিকা এবং মৃত্যু সবই নদীর জলে ভাসা নৌকায়। এই সম্প্রদায়ের নাম মান্তা। নদী ভাঙার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিভিন্ন এলাকার মানুষের এক আলালাদা আশ্রয়, আলাদা রাজ্য, আলাদা জগৎ। সভ্যতার ছোাঁয়া বিবর্জিত ভুখা নাঙ্গা এ মানুষগুলো সরকারি সুবিধা বঞ্চিত। এখানে কোমড়ে রশিতে বাঁধা পড়ে শিশু জন্মের পড়েই নৌকার গলুয়ের সঙ্গে। জীবিকার সন্ধানে মাছের আশায় নৌকা থামে নদীর বাঁকে বাঁকে। ছুটে আবার নদীর মাতাল ঢেউকেও হার মানিয়ে। এই এক মানতা বা ভাসান সম্প্রদায়ের বিচিত্র জীবন-গল্প। জীবনে মানুষ হতে পারলে পিছিয়ে পড়া এই মানতা বা ভাসান সম্প্রদায়ের গল্পটা পাল্টাতে কাজ করব।’
বগীর খালের তুলাতলী একায় নৌকায় অবস্থান করা মান্তা সম্প্রদায়ে আমানত, পিয়ারা, রুবেল সরদার, অছিয়া, শিপন, কদমআলী, রাহিমা, শুক্কুর আলী, মুক্তা নামে কয়েকজন প্রায় অভিন্ন বলেন, ‘অভি মেট্টিক পাস দিছে এইডা ভাল খবর। অভিরে দেইখ্যা আমাগো পোলাপান শিখবো। তয় প্যাড চলে না। সরকারি সুযুগ-সুবিধাও পাই না। পোলপানগুলা পড়বে ক্যামনে।’
ইউসুফের স্কুলের প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি ঘোষ মোবাইল ফোনে বলেন, ‘প্রতিক্ষণ নিদারুন লড়াই করে জীবন যুদ্ধ করছে অভি (ইউসুফ)। প্রখর অধ্যবসায়, দৃঢ় মনোবল আর কঠিন পরিশ্রম করে অন্ত্যজ বা দলিত সম্প্রদায়ের থেকে গর্বিত ভঙ্গিমায় উঠে আসছে সে। সবার প্রশংসা আর অফুরান ভালবাসা অজৃন করেছে। ওই সময়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জামানসহ সমাজের কয়েক বিশিষ্ট লোকজন তাকে সহোযোগিতা, সমর্থন ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। অভির মধ্যে লুকায়িত প্রতিভা আছে। একজন উচ্চ শিক্ষিত মানবিক মানুষ হতে অভিকে সবার সহোযোগিতা করা উচিত। এতে মান্তা সম্প্রদায়ের মতো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী অনুপ্রাণিত হবে।’