নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদসংক্রান্ত (সিডও) জাতিসংঘ কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন, অর্থনীতিবিদ ও নারী অধিকারকর্মী সালমা খান আর নেই। আজ শনিবার বেলা দুইটার দিকে রাজধানীর গুলশানের বাসায় ইন্তেকাল করেছেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।
পরিবারের পক্ষ থেকে সালমা খানকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর লাশ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা আছে। সালমা খানের যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মেয়ে উমানা হক দেশে আসতে পারবেন কি না, তা জানার পর পরিবারের সদস্যরা লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নেবেন।
এসব তথ্য জানিয়ে সালমা খানের স্বামী সাবেক মন্ত্রী হাবিব উল্লাহ খান বলেন, ‘আমি নিজেও অসুস্থ। হাঁটতে পারি না। এখন তো ও আমাকে ফেলে চলে গেল। আমি আরও একা হয়ে গেলাম।’
গুলশানের বাসায় সালমা খান ও তাঁর স্বামী থাকতেন। দুজনই দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। বাড়িতে কয়েকজন নার্স দেখাশোনা করতেন তাঁদের।
হাবিব উল্লাহ খানের নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফয়সাল ইসলাম জানান, সালমা খান মারা যাওয়ার সময় তিনি তাঁর পাশেই ছিলেন। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এক সপ্তাহ ধরেই থেমে থেমে জ্বর হচ্ছিল সালমা খানের। মাঝেমধ্যে শ্বাসকষ্ট হতো। এ ছাড়া বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
ফয়সাল ইসলাম জানান, সালমা খানের মৃত্যুর খবর তাঁর মেয়েকে জানানো হয়েছে। মেয়ে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন। তিনি এলে বা যদি না আসতে পারেন, তখন জানাজা, দাফনসহ অন্যান্য ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হবে।
সালমা খান প্রথম এশীয় হিসেবে সিডও কমিটির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমিটিতে ৩ মেয়াদে ১২ বছরের বেশি সময় তিনি দায়িত্ব পালন করেন।
সালমা খান এনজিও কোয়ালিশন ফর বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশনের সাবেক চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি এবং ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নয়ন অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেটিকাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাবলিক সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ে ডিপ্লোমা ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেন্ডার প্ল্যানিংয়ে বিশেষায়িত হন।
সালমা খান ফুলব্রাইট স্কলারশিপ, ইউএস এআইডি স্কলারশিপ, ব্রিটিশ কাউন্সিল স্কলারশিপ ও মর্যাদাপূর্ণ আইজেনহাওয়ার এক্সচেঞ্জ ফেলোশিপ পেয়েছিলেন।
‘ফিফটি পারসেন্ট: উইমেন ইন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পলিসি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের বইয়ের লেখক সালমা খান দেশের বিভিন্ন সরকারি অফিসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কর্মরত ছিলেন। জাতীয় পরিকল্পনা কমিশনে নারী উইংয়ের সূচনা ও বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার ম্যাক্রো কাঠামোতে লিঙ্গ সমস্যাকে মূলধারায় আনার জন্য তিনি ভূমিকা রেখেছেন। পরিকল্পনা কমিশনে যোগদানের আগে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতা করেন। তিনি ওই বিভাগের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ থেকে ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি।
সালমা খান নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে গবেষণা ও প্রকাশনার জন্য ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে স্বর্ণপদক পান। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে শ্রেষ্ঠ নারী প্রশাসক হিসেবে অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার এবং নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অসামান্য সেবার স্বীকৃতি হিসেবে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল জিন হ্যারিস পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
সালমা খানের গবেষণায় নারীর শ্রম অধিকার, নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, অর্থনৈতিক নীতিতে লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টিকে মূলধারায় সম্পৃক্ত করার মতো বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন তিনি।
সালমা খান ন্যাশনাল কাউন্সিল অন উইমেন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, জাতীয় শিক্ষা কমিশন, মানব উন্নয়ন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মহিয়সী এই নারী।