মেয়ে-জামাতার জন্য নিয়োগবিধিই বদল করেন রাবির সাবেক উপাচার্য - দৈনিকশিক্ষা

মেয়ে-জামাতার জন্য নিয়োগবিধিই বদল করেন রাবির সাবেক উপাচার্য

রাবি প্রতিনিধি |

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সালে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ফাইসুল ইসলাম ফারুকী অস্থায়ী ভিত্তিতে ৫৪৪ জনকে চাকরি দেন। সেই সময় এ নিয়োগের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। একইভাবে ২০০৭ সালে বাজেট না থাকা সত্ত্বেও ২০০ জন কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার প্রতিবাদে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন তিনি। তবে ২০০৯ সালে নিজে উপাচার্য হওয়ার পর ভূমিকা পাল্টে যায়। কথা ওঠে, যে-ই যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠতে থাকে। তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। অনিয়ম ও দূর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াইকারী অধ্যাপক সোবহান দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পুলিশ পাহারায় ক্যাম্পাস ছেড়েছেন।

ফলিত পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সোবহান ২০০০ সালে আওয়ামীপন্থি প্যানেল থেকে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ ছাড়া আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ'-এর আহ্বায়ক হন। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলে গ্রেপ্তার হন তিনি। ওই সময় সাড়ে তিন মাস জেল খাটেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্র জানায়, উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সিন্ডিকেট সভায় বিজ্ঞাপিত ২১টি পদের বিপরীতে ৫১ জন শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন নেন অধ্যাপক আবদুস সোবহান। প্রথম মেয়াদে তিনি ৩৩০ জন শিক্ষক নিয়োগ দেন। এর মধ্যে ৯৫ জন অস্থায়ী। এ ছাড়া কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেন ৫৯৫ জন। তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার পর আর ৫২ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। এর মধ্যে শেষ কর্মদিবসে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দেন ৯ জনকে। শেষ কর্মদিবসের আগে তিনি কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ দেন ১৯২ জনকে। শেষ দিনে নিয়োগ দেন ১৪১ জনকে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন

অধ্যাপক সোবহান সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হন নিয়োগ নীতিমালা শিথিল করে তার মেয়ে-জামাতাকে নিয়োগ দিয়ে। সংশ্নিষ্টরা জানান, নীতিমালা না বদলালে তার মেয়ে ও জামাতা আবেদন করতেই পারতেন না। আগের নীতিমালা অনুযায়ী তাদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের আবেদন করার যোগ্যতা নেই।

যোগ্যতা শিথিল :অধ্যাপক আবদুস সোবহান ৪৭৫তম সিন্ডিকেট সভায় শিক্ষক নিয়োগ-নীতিমালা পরিবর্তন করেন। আগের নীতিমালায় শিক্ষক হিসেবে আবেদনের নূ্যনতম যোগ্যতা ছিল- সনাতন পদ্ধতিতে এসএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত চারটি স্তরেই প্রথম শ্রেণি। গ্রেডিং পদ্ধতিতে এসএসসি ও এইচএসসিতে নূ্যনতম জিপিএ-৪.৫০, স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে নূ্যনতম সিজিপিএ-৩.৫০। একইসঙ্গে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তরে সংশ্নিষ্ট বিভাগের মেধাক্রমে প্রথম থেকে সপ্তমের মধ্যে থাকতে হবে। পরিবর্তিত নীতিমালায় তা কমিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৩.২৫-এ নামিয়ে আনা হয় এবং মেধাক্রমে প্রথম থেকে সপ্তম পর্যন্ত থাকার শর্ত বাতিল করা হয়।

অধ্যাপক সোবহানের মেয়ে সানজানা সোবহান নিয়োগ পান ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে।

তিনি মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্নাতকে তার সিজিপিএ-৩.৭৫ এবং এমবিএতে ৩.৬৫। তার মেধাক্রমে তিনি ছিলেন ২১তম। জামাতা এটিএম শাহেদ পারভেজ ৬৭তম মেধাক্রম নিয়ে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পান ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। বিবিএতে তার সিজিপিএ-৩.৪৭। এমবিএতেও সিজিপিএ-৩.৪৭।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আবদুস সোবহানের জামাতা ও আইবিএর শিক্ষক এটিএম শাহেদ পারভেজ বলেন, 'আমি তখন একটি প্রাইভেট (বেসরকারি) বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। পত্রিকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে আবেদন করেছি। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আমার যোগ্যতা ছিল। আগের কী নিয়মনীতি ছিল চাকরিপ্রার্থী হিসেবে তা আমার দেখার বিষয় নয়। চাকরি তো আমি নিজে নেইনি, তাই না। চাকরিপ্রার্থী হিসেবে আবেদন করেছি।'

এ বিষয়ে সানজানা সোবহানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়; তবে তার ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আইবিএর পরিচালক অধ্যাপক ড. শামসুদ্দোহা বলেন, 'কেন স্কোর কমানো হলো আমি জানি না। অনুষদে শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীই ৩.৫০ বা তার বেশি সিজিপিএ পায়। সেখানে স্কোর কেন কমানো হলো? ৩.৫০-ই কম ছিল। আমি তখনও প্রশাসনকে বলেছিলাম অন্তত আইবিএর জন্য আবেদনের যোগ্যতা বাড়ান। কারা এই নীতিমালা কমানোর পক্ষে ছিলেন, তাদের কী যুক্তি তা জানা দরকার।'

ড. শামসুদ্দোহার ভাষ্য, 'যোগ্যতা কমানোয় এই ইনস্টিটিউটে শিক্ষকের মান কমে গেছে। বর্তমানের নীতিমালায় সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটিও শিক্ষক হিসেবে আবেদনের যোগ্যতা রাখছে। উপাচার্য ও তার গঠিত কমিটি তখন কোন ধান্দায় কমিয়েছে আমি জানি না।'

শেষ কর্মদিবসে অধ্যাপক সোবহানের বিতর্কিত ১৪১ নিয়োগে ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি গত শনিবার অন্যদের পাশাপাশি জামাতা শাহেদ পারভেজকে জেরা করে। এ বিষয়ে শাহেদ পারভেজ বলেন, 'তদন্ত কমিটি আমাকে কেন ডেকেছিল জানি না। আমি তো এর সঙ্গে যুক্ত না। আমি কমিটিকে বলেছি আমি যুক্ত না তাহলে কেন ডেকেছেন? একজন আমায় বলেন, আমার রেজাল্ট খারাপ। তাহলে আইবিএতে কেন যোগ দিয়েছি? আমি বলেছি, এটি তো আজকের বিষয় নয়। দুই বছর আগের ঘটনা কেন টানছেন? তাদের আচরণে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এসব প্রশ্ন করেছেন। যেই প্রতিবেদন দেয় দিক তাতে আপত্তি নেই, ভালো লাগল কমিটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তদন্ত করতে ছুটে এসেছেন।'

'কম যোগ্য' আরও শিক্ষক :বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে অধিকতর কম যোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে অধ্যাপক সোবহানের বিরুদ্ধে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন নিয়োগ যোগ্যতায় উপাচার্যের মেয়ে, জামাতাসহ ৪৩ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উপাচার্যের মেয়ে, জামাতাসহ ৩৪ জন শিক্ষকের আগের নীতিমালায় আবেদন করারই যোগ্যতা ছিল না। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে ওই ৩৪ শিক্ষকের নিয়োগ বাতিলের পরামর্শ দেওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিয়োগ নীতিমালা শিথিলের পর চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগে ৪ জন শিক্ষক নিয়োগ পান। তাদের মধ্যে তিনজনের আগের নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন করার যোগ্যতাই ছিল না। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে নিয়োগ পাওয়া পাঁচজনের মধ্যে চারজন, ইইই বিভাগের চারজনের মধ্যে একজনের আগের নীতিমালায় আবেদন করার যোগ্যতা ছিল না। এছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ট্যুরিজম, পদার্থবিজ্ঞান, ব্যাংকিং ও ইনস্যুরেন্স বিভাগ ও ফলিত গণিত বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকেরই আগের নীতিমালায় আবেদন যোগ্যতা ছিল না।

প্রতিটি অভিযোগের বিষয়ে জানতে সদ্য বিদায় নেওয়া উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সফল হওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলে তা রিসিভ হয়নি।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005424976348877