ম্রোপল্লি চাই পাঁচতারা হোটেল চাই না - দৈনিকশিক্ষা

ম্রোপল্লি চাই পাঁচতারা হোটেল চাই না

মুহম্মদ জাফর ইকবাল |

আমাদের সবার ভেতরেই প্রকৃতির জন্য এক ধরনের ভালোবাসা আছে। আমরা সবাই মনে মনে স্বপ্ন দেখি, আমরা কোনো একদিন একটা গহিন গ্রামে ফিরে যাব। গাছের ছায়ায় পাখির কলকাকলি শুনতে শুনতে নদীতীরে বসে থাকব, ভাটিয়ালি গান গাইতে গাইতে মাঝি পাল তুলে তার নৌকা বেয়ে যাবে আর আমরা মুগ্ধ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকব। বাস্তবতার চাপে হয়তো আমরা সেটা করতে পারি না, কিন্তু তাই বলে আমাদের স্বপ্ন কখনও থেমে থাকে না।

আমি যদি আমার নিজের জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলোর কথা চিন্তা করি, ঘুরেফিরে সেই প্রকৃতির কাছাকাছি সময়গুলোর কথা মনে পড়ে। দিনাজপুরের কাছাকাছি জগদল নামের এলাকায় সুবিস্তৃত আমবাগান, জনমানুষ নেই সেরকম নিবিড় অরণ্য, বালুর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্ষীণস্রোতা নদী, কত কী ভুলে গেছি; কিন্তু প্রকৃতির সেই কোমল দৃশ্য ভুলতে পারি না। বান্দরবানের কথা মনে পড়ে। নদীর ওপারে টিলার ওপর লক্ষ লক্ষ বানর! নির্জন নদীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছি, একজন মারমা মহিলা পিঠে ঝোলানো বোঝা নিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে হেঁটে যেতে যেতে থেমে গিয়ে আমাকে তাদের ভাষায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করেছে এত ছোট বাচ্চা একা একা কই যাও? আমি ভাষা জানি না বলে উত্তর দিতে পারি না। একটু বড় হয়ে পিরোজপুরে এসেছি। বাবার সঙ্গে নৌকায় করে তার ট্যুরের সঙ্গী হয়েছি। নৌকার ছাদে বসে অবাক হয়ে নদীর সৌন্দর্য দেখছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সুন্দরবনে গিয়েছি, অবাক বিস্ময়ে গহিন অরণ্যের দিকে তাকিয়ে আছি। শুধু নিজের দেশের স্মৃতিই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ বছর কাটিয়ে এসেছি। ডোনাল্ড ট্রাম্পের তৈরি মানুষের ভেতরে হিংসা, বর্ণবিদ্বেষের দগদগে ঘায়ের কথা তখন জানতাম না। আপনজনের মতো তাদের সঙ্গে পর্বতে উঠেছি, তুষারের ওপর ক্যাম্প করে থেকেছি। বন্ধুদের নিয়ে অরণ্যে, হ্রদে ঘুরে বেড়িয়েছি। সেই দেশে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা; কিন্তু যদি মধুর সময়ের কথা চিন্তা করতে চাই ঘুরেফিরে শুধু প্রকৃতির সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে। আমি বুঝতে পেরেছি এই পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হচ্ছে তার আদি এবং অকৃত্রিম প্রকৃতি।

সেই প্রকৃতিকে ধ্বংস করার সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর পদ্ধতি কী? সেটি হচ্ছে সেখানে একটা পাঁচতারা হোটেল বানিয়ে ফেলা। যেখানে কাঁচা পয়সার মালিকেরা এসে এয়ারকন্ডিশন ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিশুদ্ধ ইংরেজিতে বলবেন, 'হাউ বিউটিফুল!' তাই যেদিন আমি খবরের কাগজে দেখেছি ম্রোপল্লি উচ্ছেদ করে সেখানে একটা পাঁচতারা হোটেল হবে। আমার মনে হলো কেউ যেন আমার বুকের ভেতর এসে আঘাত করেছে!

শৈশবে আমার বাবার চাকরিসূত্রে আমাদের পরিবারের সবাই রাঙামাটি এবং বান্দরবানে ছিলাম। শুনেছি আমরা যেখানে থাকতাম তার পুরো এলাকাটা কাপ্তাই লেকের নিচে ডুবে গেছে। (আমার এখনও বিশ্বাস হয় না যে, সেখানে যে মানুষগুলো ছিল একদিন তারা অবাক হয়ে দেখল ধীরে ধীরে পানি উঠে তাদের পুরো এলাকা তলিয়ে যাচ্ছে। মানুষ কেমন করে প্রকৃতির দোহাই দিয়ে এত বড় একটি এলাকার আদিবাসীদের এত বড় সর্বনাশ করতে পারে?)

বান্দরবানের স্মৃতি আমার জীবনের অনেক মধুর স্মৃতি। আমাদের ক্লাসে হিন্দু, মুসলমান, চাকমা এবং মারমা ছাত্রছাত্রী ছিল। মারমা বন্ধুদের সঙ্গে তাদের বাড়ি গিয়েছি, মাচাং-এর ওপর বাসা, নিচে গবাদিপশু। দেখে মনে হয়েছিল, আহা, আমাদের বাসাগুলো এরকম হলো না কেন? বাবা পুলিশে চাকরি করতেন। মাঝে মাঝে গহিন গ্রামে যখন আরাকান থেকে ডাকাতরা এসে ডাকাতি করত তখন আমার বাবাকে তদন্ত করতে যেতে হতো। দুই-এক সপ্তাহের জন্য বাবা চলে যেতেন। যেদিন বাবা ফিরে আসবেন আমরা গিয়ে নদীতীরে বসে থাকতাম। দূর থেকে একটা নৌকা আসত, আর আমরা ভাইবোনেরা বলতাম, বাবা নিশ্চয়ই এই নৌকায় আছেন! কাছে এলে দেখতাম নেই। তখন পরের নৌকার জন্য অপেক্ষা করতাম। যখন সত্যি সত্যিই একটা নৌকায় বাবাকে পেয়ে যেতাম তখন আমাদের কী আনন্দ! বাবারা যখন বাইরে থেকে ফিরে আসে তখন কত রকম উপহার নিয়ে আসেন; কিন্তু গহিন অরণ্য থেকে বাবা আর কী আনবেন? কখনও পাহাড়ি জ্বর নিয়ে আসতেন, কখনও মাথার মাঝে এই বড় জোঁক! একবার একটা টিয়া পাখির বাচ্চা নিয়ে এলেন। তবে আমাদের বড় আকর্ষণ ছিল আরাকানের ডাকাতের গল্প। একবার বাবা তাদের তৈরি চারমুখী কাঁটা নিয়ে এলেন। সেগুলো নিচে ফেলে দিলে তার যেকোনো একটা সুচালো মাথা খাড়া হয়ে থাকে। অসাবধানে পা দিলেই পায়ে গেঁথে যাবে। ডাকাতরা ডাকাতি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় এগুলো ফেলে যেত। কেউ তাহলে তাদের পিছু নিতে পারত না!


তবে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় ছিল বাবার তোলা সেই এলাকার ছবি। তার খুব ফটোগ্রাফির শখ ছিল। ক্যামেরায় ছবি তুলে আনার পর সেগুলো প্রিন্ট করতে চট্টগ্রাম পাঠাতেন। প্রিন্ট হয়ে আসতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যেত! ছবিগুলো দেখে মনে হতো সবকিছু কত রহস্যময়।

একবার আমার হাত মচকে গেল। কনুইয়ের একটা হাড় কেমন যেন বিচিত্রভাবে কনুই ঠেলে বের হয়ে আসছে। হাসপাতালের ডাক্তার বললেন, তারা ঠিক করার চেষ্টা করতে পারেন কিন্তু এসব কাজ সবচেয়ে ভালো করতে পারেন আদিবাসী মারমা কবিরাজেরা। সেরকম একজনকে খবর দেওয়া হলো। দেখলাম ছোটখাটো থুরথুরে এক মারমা বুড়ি টুকটুক করে হেঁটে আমাদের বাসায় এসেছেন। আমার কনুইটা পরীক্ষা করে বিড়বিড় করে নিজের ভাষায় কিছু কথা বললেন, আমরা কিছু বুঝতে পারলাম না।

আমাদের কোনো কথাও তিনি বুঝতে পারেন না। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হলো না। আকারে-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় করে তিনি চলে গেলেন। পরদিন ভোরবেলা তিনি হাজির। তার পুঁটলির ভেতর নানা ধরনের পাতা মিশিয়ে বেটে আনা সবুজ রংয়ের একটা পেস্ট তার সঙ্গে ছোট ছোট কাঠি দিয়ে তৈরি চতুস্কোণ একটা জালের মতো জিনিস। সবুজ জিনিসটা আমার কনুইয়ে লাগিয়ে ওপরে জালির মতো সেই জিনিসটা বেঁধে দিয়ে বিড়বিড় করে অনেক কিছু বলে চলে গেলেন।

পরদিন ভোরে আবার তিনি হাজির। জালিটা খুলে জায়গাটা পরীক্ষা করে একটুখানি তেল হাতে নিয়ে কনুইটা মালিশ করে আবার নতুন করে তৈরি করে আনা সেই সবুজ পেস্ট লাগিয়ে জালিটা বেঁধে দিলেন। যতক্ষণ তিনি তার এই অতিবিচিত্র কবিরাজি চিকিৎসা করছেন ততক্ষণ তার বয়সের বলিরেখা-ঢাকা দন্তহীন মুখে বিড়বিড় করে আমার সঙ্গে কথা বলেন। কথা বলতে বলতে ফিক করে হেসে দেন। আমি কিছু বুঝি না। শুধু অনুভব করি, তার দুই চোখে আমার জন্য মায়া।

এইভাবে চলতে লাগল এবং আমরা দেখতে পেলাম আমার সেই বিদঘুটে হাড় ঠেলে বের হয়ে থাকা কনুই একটু একটু করে ভালো হয়ে যাচ্ছে। একদিন জালি খুলে তার মুখে হাসি বিকশিত হলো। আমি বুঝতে পারলাম, আমার চিকিৎসা শেষ, আমি ভালো হয়ে গেছি।

বয়সে খুব ছোট ছিলাম তাই কিছু বিশ্নেষণ করার ক্ষমতা ছিল না। এখন বুঝতে পারি, এই বৃদ্ধ মহিলার কাছে আরও না জানি কত রকম রোগের চিকিৎসা আছে। সেই পাহাড়ে তার মতো আরও কত বৃদ্ধার কাছে না জানি আরও কত রহস্যময় ওষুধ আছে! সেগুলো নিয়ে যদি একটুখানি গবেষণা হতো, না জানি কত বিস্ময়কর তথ্য বের হয়ে আসত!

এত বছর পরেও রাঙামাটি, বান্দরবান আমার খুব প্রিয় এলাকা। বেশ কিছুদিন আগে সেখানে গিয়েছি। একজন আমাকে একটা আবাসিক স্কুলে নিয়ে গেছে। স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলছি, হঠাৎ দেখি ছোট একটা শিশু খুবই কুণ্ঠিতভাবে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে একটা বই। একনজর দেখেই বুঝতে পারলাম, আমার লেখা বই। সে নিশ্চয়ই সেখানে একটা অটোগ্রাফ চায়। সাহস করে কাছে আসতে পারছে না! আমি তাকে ডেকে কাছে এনে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে অটোগ্রাফ দিয়ে দিলাম। কথা বলে বুঝলাম সে একজন ম্রোশিশু। পাহাড়ে স্কুলের সংখ্যা খুব কম, তাই দূর-দূরান্ত থেকে বাচ্চা শিশুদেরও বোর্ডিং স্কুলে থেকে লেখাপড়া করতে হয়। আমার কাছে মনে হলো, আহা আমি যদি এই পাহাড়ি শিশুদের জীবনকথা আরও ভালো করে জানতে পারতাম। তাদের নিয়ে একটা বই লিখতে পারতাম। তাহলে এই শিশুগুলো নিশ্চয়ই আরও কত খুশি হতো!

আমার এই সুদীর্ঘ জীবনে অনেক কিছু দেখে আমি নিশ্চিত হয়েছি, এই পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ দুটি- একটি হচ্ছে প্রকৃতি, অন্যটি সেই প্রকৃতির কোলে বড় হওয়া আদিবাসী মানুষ। আমার দেশে এই দুটিরই খুবই অভাব। তাই তারা যে ক'জন আছে আর তাদের যেটুকু জায়গা আছে সেটাকে আমাদের বুক আগলে রক্ষা করতে হবে।

তাই আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করি, ম্রোপল্লি উচ্ছেদ করে সেখানে পাঁচতারা হোটেল বানাবেন না। এ জায়গাটুকুতে অতি মূল্যবান মানুষদের নিজেদের সংস্কৃতিকে নিয়ে তাদের মতো করে বেঁচে থাকতে দিন!

দোহাই আপনাদের!

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.014097929000854