শিক্ষক নিপীড়ন, বিপর্যস্ত শিক্ষা কাঠামো ও আমাদের দায় - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষক নিপীড়ন, বিপর্যস্ত শিক্ষা কাঠামো ও আমাদের দায়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

একটা সমাজ বেঁচে থাকে তখনি যখন শিক্ষা আর শিক্ষাকেন্দ্র মানুষের জীবনমান উন্নতকরণে সবচেয়ে বেশি সহায়ক হতে পারে। কিন্তু শিক্ষকরাই যদি সেই সমাজে অবহেলিত হয়, লাঞ্ছিত হয়, আর নিপীড়িত হয়; তাহলে বুঝতে হবে আমরা সমাজের হন্তারক। কিছুদিন ধরে এ ধরনের সংকট এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নীতি শৃঙ্খলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তারই সাক্ষ্য দেয়। রোববার (১৭ জুলাই) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ী ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে গুরুতর জখম করার অভিযোগ নিয়ে তোলপাড় চলছে। এ ধরনের নিপীড়নের ঘটনা যদি একজন সাংসদের হাতেই চালিত হয় তা শুধু দুঃখজনক নয়, নির্মম ও অস্বস্তিকর। তার আগেও শিক্ষক লাঞ্ছনার কয়েকটি ঘটনা পুরো জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও নিপীড়নের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। গত ২৫ জুন শনিবার আশুলিয়ার হাজি ইউনুছ আলী স্কুল এন্ড কলেজের দশম শ্রেণির এক ছাত্র (১৬) ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে তারই শিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে। তারই কিছুদিন আগে গত ১৮ জুন নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরায় কলেজের ছাত্র ও স্থানীয় কিছু লোক, খোদ পুলিশের সামনেই। এরও আগে গত এপ্রিল মাসে ‘ধর্মের অবমাননা’র অভিযোগ তুলে মুন্সীগঞ্জের এক স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের, অতঃপর মামলাটি আমলে নিয়ে শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক বছর আগেও শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় সবাই বাকরুদ্ধ হয়েছিল। ধর্ম নিয়ে কটূক্তির ‘অভিযোগ’ এনে ২০১৬ সালের ১৩ মে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পিয়ার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সামনে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। কেন শিক্ষকদের ওপর নিপীড়নের কালচার জারি হয়েছে? কেনই বা শিক্ষকদের সম্মানের কালচার বিনষ্ট হয়েছে? এর একটা ময়নাতদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

একজন অধ্যক্ষকে একজন সাংসদ যদি কয়েকজন অধ্যক্ষের সামনে হকিস্টিক দিয়ে পেটায়, তা শুধু শিক্ষাব্যবস্থার জন্য লজ্জাজনক নয়, গোটা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার জায়গা থেকে নিন্দনীয়। শিক্ষক অধ্যক্ষ কতটা অসহায় হলে স্বচক্ষে এমন ঘটনা দেখেও সবাইকে নিশ্চুপ থাকতে হয়। এমনকি ভুক্তভোগী অধ্যক্ষকে হয়তো বলতে বাধ্য করা হচ্ছে যে, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেইনি। এর মানে নিপীড়িত হবে কিন্তু বিচার চাওয়া যাবে না। যদিও সব সত্যতা সঠিক তদন্তের ওপর নির্ভর করছে, তবুও সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা তথ্যানুযায়ী এটা বলা যায় যে, শিক্ষাব্যবস্থা এখন জ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রে পরিচালিত হচ্ছে অপরাজনীতির পেশিশক্তিতে। এই কালচার জারি রাখার প্রেক্ষিতে এক একজন অধ্যক্ষকে চলতে হচ্ছে মসজিদের ইমামের মতো, যে ইমামকে মসজিদ কমিটির আনুগত্য করতে বাধ্য করা হয়। অধ্যক্ষদের শুধু আনুগত্য করলেই হচ্ছে না, তাদের রাজনৈতিক নেতাদের তোষামোদি করতে হয়। সে কারণে শিক্ষক, অধ্যক্ষদের কথাগুলো রেকর্ড করে সাংসদ বা দলীয় নেতাদের কাছে শোনানো হয়। এসবই হচ্ছে একজনকে ফাঁসিয়ে আরেকজন কীভাবে কোন পদ উদ্ধার করবে সেই লোভের তাড়না থেকে। এর মানে শিক্ষাব্যবস্থায় জ্ঞান ও শিক্ষা এখন নিগৃহীত। শুধু তাই নয়, আমাদের বিশ্বাস করতে হলো যে, স্কুলশিক্ষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করে তারই ছাত্র। সাধারণ কল্পনায় মনে হবে, ছাত্রটি হয় মানসিক বিকারগ্রস্ত, না হয় মাদকাসক্ত। তবে এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে স্কুল ছাত্রছাত্রীদের ওপর অস্ত্রধারী বিকারগ্রস্ত সন্ত্রাসীদের হামলার ঘটনার মতো না হলেও এটি সমাজের বিকারগ্রস্ত রূপকে উন্মোচিত করে। আমাদের সময়ে আমরা স্কুলশিক্ষকদের সম্মান ও ভয়ের চোখে দেখতাম। অথচ সেই চিত্র এখন উল্টে গেল। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্কুলের নিয়ম ভঙ্গ আর মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার মতো অপরাধে জড়িত থাকলেও স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ছিল নির্বিকার। এর মূল কারণ, সেই বখাটে ছাত্র স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির আত্মীয় ছিল। এর মানে ক্ষমতা কাঠামো পুরোপুরি পাল্টে গেছে। স্কুলে শিক্ষক আর অধ্যক্ষের হাতে শাসন করার বা টিসি দেয়ার যে ক্ষমতা ছিল, তা এখন প্রভাবশালী ম্যানেজিং কমিটির হাতে, যাদের কাছে শিক্ষার মান গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার বিষয়কেও শিক্ষক নিপীড়নের হাতিয়ার বানানো হয়েছে। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, ধর্মের অবমাননায় ‘অভিযুক্ত’ ছাত্রকে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের হাতে তুলে দেয়নি বলে ছাত্র আর স্থানীয় লোকেরা তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়। এক্ষেত্রে পুলিশ অধ্যক্ষকে নিরাপত্তা তো দেয়নি, উল্টো পুলিশের সামনেই জুতা পরিয়ে দেয়। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের সম্মানের পরিবর্তে ধর্মের উন্মাদনা সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক জিঘাংসায় মেতে ওঠার কালচারকে উৎসাহিত করা হয়। অনুসন্ধানী তথ্যে জানা যায়, ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার কলেজের ম্যানেজিং কমিটির বিরাগভাজন ছিলেন। পদলোভীরা তাকে পদ থেকে সরানোর পথ খুঁজছিল। সুযোগ পেয়ে গুজব সৃষ্টি করে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। যদিও বিষয়ের সত্যতার জন্য তদন্ত কমিটির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটুকু বলা যায়, মুনাফাখোর বা দুর্নীতিবাজরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে হাটে হাড়ি ভাঙতে অনেক দক্ষ।

ধর্মের অবমাননার ‘অভিযোগ’ তুলে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলা ও কারাগারে প্রেরণ এর ঘটনা ছিল শিক্ষক লাঞ্ছনার আরেকটি উদাহরণ। ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিতর্ক পুরনো হলেও ডায়ালজিক্যাল মেথডে একজন শিক্ষক ক্লাস নিতেই পারেন। কেউ বিজ্ঞানের ভক্ত হতে পারে, কেউ ধর্মের ভক্ত হতে পারে, আবার কেউ ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্মিলনকে গুরুত্ব দিয়ে চলতে পারেন; কিন্তু শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রদের অবস্থান নেয়ার কালচার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে কঠিন সংকটে ফেলে দিচ্ছে। আমাদের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস আর আবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা যে শিক্ষকদের অসম্মান করার অনৈতিক কৃষ্টি চালু করছি তার পরিণতি যে কত ভয়াবহ তা আমরা বুঝতে পারিনি। একটা সমাজ কতটা অজ্ঞতা আর মূর্খতার মধ্যে ডুবে থাকলে ধর্মের বিশ্বাসকে শিক্ষকদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতিপক্ষ মনে করে। এ ধরনের ডিস্কোরস অব্যাহত থাকলে ধর্মের বাহ্যিকতার পোশাক পরে স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতি আর অযাচিত প্রভাব বিস্তার বাড়তেই থাকবে। সবচেয়ে গুরুতর দিক হলো, শিক্ষা আমাদের যে মূল্যবোধ শেখানোর কথা তার চর্চা দুর্বল হবে আর অন্যায় অবিচারের কালচার ব্যাপকতা লাভ করবে। আমরা ধর্মের আবেগকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে এভাবেই হারিয়ে ফেলছি শিষ্টাচার, আর নৈতিকতা; প্রকারান্তরে নিজেরাই ধর্ম বিরোধী হয়ে পড়ছি। কোথায় সহনশীল হয়ে জ্ঞানের ভাষায় কথা বলতে হবে, আর কোথায় অন্যায় অবিচার আর অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, এই বোধটুকু আমাদের মধ্যে জন্ম হয়নি। সে কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষোভ নেই, আমাদের ক্ষোভ ‘ধর্মের’ বাহ্যিকতা নিয়ে। আমরা এমনি দুর্ভাগা যে, স্কুলের প্রধান শিক্ষককে কান ধরে ওঠবস করানোর মতো বর্বরতার দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়। শিক্ষকের সম্মান বলতে কিছু নেই, তবে স্থানীয় মাতব্বর বা জনগণের ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারীদের সম্মান অনেক। আমরা এমনি শিক্ষা অর্জন করি যে, শিক্ষা দানকারীকে সম্মানের কালচার আমাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। উল্টো, যার কাছে আমরা কিছু টাকা-পয়সা বা সুবিধা পাব তাকে তোষামোদ করার কালচার আমরা ভালোই রপ্ত করেছি। কঠিন সামাজিক সংকট হলো, এলাকার মানুষ অধ্যক্ষকে জুতার মালা পরায়, কান ধরে ওঠবস করায়; কিন্তু কোনো এলাকার মানুষ বড় অঙ্কের ঘুষ খাওয়ার কারণে কোনো ঘুষখোরকে নাজেহাল করে না। এলাকার মানুষ এমন অধ্যক্ষদের এই পদে দেখতে চায় না, কিন্তু দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে নীরব।

এর মানে ছাত্রছাত্রীরা যে শিক্ষালয়ে লেখাপড়া করছে সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনতেই হবে। কেননা এত সব শিক্ষক বা অধ্যক্ষ লাঞ্ছনার মূল কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দুর্নীতি আর শিক্ষক সম্প্রদায়কে অপরাজনীতির মধ্যে জড়িয়ে ফেলা। এ সমস্যার সমাধান করতে পারলেই ধর্মের অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হবে। সেজন্য দরকার শিক্ষালয়ে ম্যানেজিং কমিটির সংস্কার। এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে অভিজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ম্যানেজিং কমিটিতে নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনোরূপ অন্যায় অনাচার যেন প্রশ্রয় না পায় সেজন্য অপরাজনীতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। শুধু তাই নয়, ধর্মের নামে গোলযোগ সৃষ্টিকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সবার আগে, যারা শিক্ষক নিপীড়ন ও লাঞ্ছনার জন্য দায়ী তাদের কঠিন শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। তারপরই সংস্কারে হাত দিতে হবে। শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিনির্মাণ এখন অতি জরুরি।

লেখক : ড. আশেক মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064449310302734