শিক্ষকতা পেশা লোভনীয় হোক - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকতা পেশা লোভনীয় হোক

নৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস |

প্রযুক্তির উৎকর্ষে বদলে যাচ্ছে বিশ^। বদলে যাচ্ছে চারপাশ। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন স্বপ্ন বাংলাদেশকে স্মার্ট হিসেবে গড়ে তোলা। স্মার্ট বাংলাদেশ হলো একটি প্রতিশ্রুতি ও শ্লোগান যা ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের পরিকল্পনা। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে চারটি মূলভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে এবং এগুলো হলো- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট এবং স্মার্ট সোসাইটি।

মূলত স্মার্ট বাংলাদেশ বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর নির্মল ও স্বচ্ছ তথা নাগরিক হয়রানিবিহীন একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণ প্রক্রিয়া। আর এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভূমিকা শিক্ষকদের। স্মার্ট শিক্ষক ছাড়া স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা কখনই সম্ভব নয়। দেশ সেরা মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করলে প্রত্যেক শিক্ষক হবেন স্মার্ট ও দক্ষ।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। অন্য সব চাকরির মতো শিক্ষকতা পেশা লোভনীয় ও আকর্ষণীয় না হওয়ার কারণে মেধারীরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। একটা সময় ছিলো যখন মান-মর্যাদায় শিক্ষকরা ছিলেন সবার উপরে। অন্যের সন্তানকে মানুষ করার অদম্য প্রয়াস ছিলো শিক্ষকের মাঝে। তাদের নীতি ও আদর্শ ছিলো সবার ঊর্ধ্বে। শিক্ষকরা ছিলেন সর্বদা আন্তরিক। কিন্তু দিনে দিনে শিক্ষকদের মধ্যে নানা নেতিবাচক ঘটনা পেয়ে বসেছে! নোট-গাইড পড়ানোর বদনামের পাশাপাশি রয়েছে কোচিং-বাণিজ্যের বদনাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির মতো ঘটনাও নেহায়েত কম শোনা যায় না! প্রশ্নফাঁসের সমস্যার সাথে শিক্ষকদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার যাচ্ছে! এখন  খুব কম শিক্ষকের মধ্যে বই পুস্তকে লেগে থাকার অভ্যাস রয়েছে!

একজন শিক্ষকই পারেন অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে সঠিক দীক্ষায় দীক্ষা দিতে। শিক্ষকের ভালোবাসা, স্নেহ ও কোমল-কঠিন সংস্পর্শে খারাপ বা কম মনোযোগী শিক্ষার্থীও ভালো হয়ে যেতে পারেন। ‘এডুকেশন ওয়াচ’- এর এক রির্পোট বলছে, অর্ধেকের বেশি  শিক্ষার্থী এখন আর শিক্ষকদের আদর্শ মনে করেন না। এটা খুব খারাপ সংবাদ বটে! মূলত ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সুসম্পর্কই সারিয়ে তুলতে পারে শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও অস্বস্তিকর বিষয়গুলোকে। মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদেরও এখন ভয়ে থাকতে হয়। কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে শিক্ষকদের। শিক্ষকরা বর্তমানে কতোটা অসহায় তা আশাপাশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাবলী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষককে অপমান, নির্যাতন করার মতো ঘটনা মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষককে অপমান, অপদস্থ, গায়ে হাত তোলার মতো ধৃষ্টতার ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার।

এ সমাজে যতো ধরনের পেশা আছে সেগুলোর মধ্যে তুলনামূলক সম্মানজনক, আদর্শপরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ পেশা হলো শিক্ষকতা। কেন জানি মনে হয়, শিক্ষকতাকে আমরা নিজেরাই ছোট করে রেখেছি!  বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারকে অনেকেই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখে! কেননা অন্য ক্যাডারে চাকরি পেতে সবাই হুমড়ি খেড়ে পড়ে। প্রশাসন, পুলিশ ও করসহ অন্য সব ক্যাডারে যেসব সুবিধা পাওয়া যায় শিক্ষা ক্যাডারে তা পাওয়া যায় না। ফলে শিক্ষকতা করার ইচ্ছে থাকলেও সুযোগ-সুবিধার কারণে মেধাবীরাই শিক্ষকতাকে এড়িয়ে যেতে চান। শিক্ষকের নিরাপত্তা বিষয়ে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ও আইএলওতে পর্যন্ত নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে শিক্ষকের নিরাপত্তাজনিত কোনো নীতিমালা নেই। ভারতের বেতন কমিশনে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে, শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষা ও বৃদ্ধিতে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি গত ১২ বছরেও। ফলে মেধাবীরা এ পেশায় আসছেন না । আবার যারা আছেন তারাও নিজ পেশায় মনোযোগ না দিয়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকে আছেন। 

পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর অধ্যাপক আবুল ফজল ‘শেখ মুজিবকে যেমন দেখেছি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। শিক্ষা ও শিক্ষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অগাধ শ্রদ্ধার কথা এই পুস্তকে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সময় বদলালেও শ্রদ্ধা-ভালোবাসার বদল কখনো হয় না। তবে মনে হয়, যা ভাবা হচ্ছে সময় তার চেয়ে একটু বেশি খারাপ। আগে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের ভয় করতেন, কিন্তু এখন শিক্ষক ভয় করেন শিক্ষার্থীদের! যদিও এর পেছনে যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। অন্যান্য চাকরির থেকে বেতন কম পেলেও একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি ও সম্মান তার আত্মমর্যাদা। শিক্ষক সমাজ যত আক্রান্ত হবে, এ সমাজে সামাজিক মূল্যবোধ তত রসাতলে যাবে। 

শিক্ষককে দেখলে শিক্ষার্থীর মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেতো। কোথায় গেলো সে সম্মান? যে বা যারা শিক্ষককে অপমান করছে তারা এর আগেও ছোটখাটো অপরাধ করে পার পেয়ে গেছে, তা না হলে শিক্ষককে অপমান করতে তারা সাহস পেতো না। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক হবে স্নেহ-শ্রদ্ধার, আন্তরিকতার ও বন্ধুত্বের। শিক্ষকের প্রতি যদি একটার পর একটা আঘাত নেমে আসে তাহলে বুঝতে হবে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ, চরিত্র, শিষ্টাচারের ভিত্তিটা কোথাও যেনো একটু হলেও নড়ে গেছে। বই পড়া কমে যাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত মোবাইলের ব্যবহার, শিক্ষার্থীদের প্রতি অনুশাসনের অভাব, পারিবারিক বন্ধনহীনতা, মূল্যবোধের অভাব, আদর্শহীনতা, সস্তা রাজনীতির প্রভাব, অপরাধীর কঠোর শাস্তি না হওয়া, অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা ইত্যাদি কারণে কিছু শিক্ষার্থী যেনো দিনের পর দিন তাদের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

শিক্ষক সমাজকে একর পর এক অপমান জাতির জন্য অশনিসংকেত। শিক্ষককে অপমান করে কোনো জাতি মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারেনি, পারবেও না। শিক্ষক সমাজকে অপমান ও হেনস্তাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। 

২.
শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ’। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে সংগঠনটি শিক্ষকদের অধিকার ও মানসম্মত শিক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সভা, সেমিনার ও মানবন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে সংগঠনটি শিক্ষক সমাজের প্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের মতো বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের ষষ্ঠ গ্রেড, সহপ্রধানদের সপ্তম গ্রেড প্রদানসহ সংগঠনের পাঁচ দফা যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। মানসম্মত শিক্ষা পেতে হলে মানসম্মত শিক্ষক তথা দেশ সেরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ও যৌক্তিক বেতনকাঠামো কার্যকর করা হলে শিক্ষার মানও বৃদ্ধি পাবে। এখনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত সোনার বাংলা গড়তে মানসম্মত মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রান্তিক এলাকায় সরকারি সুযোগ-সুুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’(এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত দেশ গঠনে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের বিকল্প নেই। স্মাট বাংলাদেশ গড়তে শিক্ষকতা পেশাকে সব পেশার উপরে স্থান দিতে হবে। এককথায় শিক্ষকতা পেশা সবচেয়ে লোভনীয় হোক। শিক্ষাক্ষেত্রে যুগোপযোগী নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় আইসিটি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নতুন কারিকুলাম দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করি।

লেখক: নৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস, সভাপতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ ও প্রধান শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ

 

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058910846710205