শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

নতুন বছরে নতুন শিক্ষা পাঠ্যক্রম নতুন একটি আশার কথা। যেখানে সৃজনশীল বিষয় আছে, একই সঙ্গে পরীক্ষার চাপ কম আছে। মুখস্থ না করে কীভাবে বিষয়গুলো ভালোভাবে বোঝা যায় সেগুলো নিশ্চিত করা হচ্ছে। এখানে অনেক রকম ভালো উপকরণ আছে। সমস্যা হলো, যারা শেখাবেন তারা প্রস্তুত হননি এখনো। তাদের প্রস্তুত না হওয়া পর্যন্ত সুফল আসবে না। তাদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। আমাদের চেষ্টা আছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যে মানের শিক্ষক আমাদের প্রয়োজন, সেই মানের শিক্ষক আমাদের বেতন ব্যবস্থার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয়। এটি আশা করাও বাতুলতা। সরকার ও কর্তাব্যক্তি যারা আছেন বিষয়টি নিয়ে তাদের আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দ এখনো জিডিপির দুই শতাংশের ধারেকাছে ঘুরছে। সেখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নতি করছে। বলা বাহুল্য, ৭৪ সালের যে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন তৈরি হয়েছিল, সেখানে এ ব্যাপারে সুপারিশ ছিল। শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জোগান দিতে না পারলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও পশ্চাদপদ থেকে যাবে। ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে প্রথমত শিক্ষকদের দক্ষতা অর্জন করা দরকার।  বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) খবরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরো জানা যায়, শিক্ষাক্রমের মধ্য দিয়ে ভালো পাঠ্যক্রমকে সঠিকভাবে রূপান্তর করা দরকার। শিখন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে দক্ষতার প্রয়োজন। সেটি অল্প বেতনের প্রাথমিক শিক্ষক দ্বারা তৈরি হবে না। একটি সুযোগ যেহেতু আমাদের হাতে আছে এবং সেটি প্রমাণ করার সক্ষমতা আমাদের আছে। বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করে আমরা যদি ৭০-৮০ হাজার টাকা একজন শিক্ষককে দিতে পারি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থীও শিক্ষকতা পেশায় উৎসাহিত হবে। বিশেষ করে মেয়েরা যদি বেশিমাত্রায় অংশগ্রহণ করে সেটি হবে আশাব্যঞ্চক। একই সঙ্গে ভালো প্রশিক্ষণ যদি তারা পায়, সেটি আমাদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। গাইড বই, নোট বই যারা শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেন, তারা একটা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। যাদের এখন অনেক ক্ষমতা। তারা এই ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আমরা ছাত্রজীবনে গাইড বই ইত্যাদি কখনো দেখিওনি; কিন্তু আমরা ঠিকই পড়াশোনা করেছি। ভালো ফলাফলও করেছি। আমরা একে অপরকে সাহায্য করতাম। আমি আমার এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে অঙ্কটা বুঝে নিতাম। কারণ অঙ্কে সে ছিল ছোটখাটো যাদব ঘোষ। তার বাড়ি যেতে হতো নদী পার হয়ে। সে আবার আমার কাছে আসত ইংরেজিটা দেখে নিতে। এতে আমাদের পরীক্ষার ফলে ভালো প্রভাব পড়ত।

আমাদের সময় শিক্ষকরাই যা পড়াবার পড়াতেন। এখন অনেকেই কোচিং করেন। তারা গাইড বই পড়ায় উৎসাহ দেন। অথচ শিশুরা পাঠ্যপুস্তক থেকে জ্ঞান আহরণ করতে সক্ষম। তবে তাদের জন্য সহায়ক হিসেবে শিক্ষকদের এবং পরিবারের একটা ভূমিকা থাকতে হবে। তাদের জন্য রিডিং ক্লাব করা যেতে পারে। অর্থাৎ সব পড়া স্কুলে পড়ে নিতে হবে। আর গাইড বই ও নোট বই পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। এসব শিক্ষার্থীকে নিজ থেকে চিন্তাভাবনা করার সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের গাইড বই, নোট বই লেখা বন্ধ করতে হবে। এসব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী দুজনেই শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে চান। তারা সৃজনশীল পদ্ধতির ব্যাপকতার মধ্য দিয়ে শিক্ষার মান বাড়াতে চান। তবে একদিনে তা সম্ভব নয়। এখন সরকার যা করতে পারে, তা হলো– শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো দরকার। স্কুলের মান উন্নত করা দরকার। দিনের সব পড়া স্কুলেই শেষ করা দরকার। মুখস্থ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে সৃজনশীল শিক্ষার দিকে যাওয়া দরকার। 

শিক্ষার্থীদের নিজেদের সক্ষমতা আবিষ্কারের পথ খুলে দেওয়া দরকার। কোচিং প্রথা ও গাইড বইয়ের সিন্ডিকেট ব্যবসা বন্ধ করা দরকার এবং সরকার চাইলে তা সম্ভব। 

যেকোনো বিষয়ের উৎসমূলের দিকে আমাদের তাকাতে হবে। আমাদের শিক্ষকদের বেতন এখনো অপ্রতুল। যা দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করা সম্ভব নয়। তাই অনেকাংশে শিক্ষকরা প্রাইভেট কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন। আমাদের ক্লাসগুলোয় শিক্ষার্থী বেশি হওয়ায় সব শিক্ষার্থী ক্লাসের পড়া ক্লাসে বুঝে নিতে পারে না। এ জন্যও প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষকদের ভালো বেতন-ভাতা দিলে, সব পড়া স্কুলে শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে, পড়ানোর পদ্ধতি ও পাঠ্যবই আকর্ষণীয় হলে তেমন কোনো সমস্যা থাকবে না। তাই শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিত। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষার আলোর বিচ্ছুরণ ঘটাতে হবে। তারা যখন শেখার আনন্দ পেয়ে যাবে তখন আর প্রযুক্তির অপব্যবহার করবে না। এজন্য তাদের নিয়মিত অ্যাসাইন্টমেন্টের আওতায় রাখা উচিত। তাদের যদি আমরা ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি বিষয়ে গ্রুপভিত্তিক কাজ করতে দিই, তাহলে তারা এতে খুবই আকৃষ্ট হবে। প্রতিযোগিতায় ও আনন্দে তারা পড়া শেষ করে ফেলবে।

রাষ্ট্র গড়ার কারিগর শিক্ষক; কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষকদের অনেকেই একে প্রথম পছন্দ হিসেবে নেননি। অনেকের যোগ্যতারও অভাব আছে। মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসতে চান না। তার কারণ, এখানে বেতন-ভাতা কম। বিসিএসে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্তরা প্রশাসন, কাস্টমস, ফরেন ক্যাডার হতে চান। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন দিলে তারা শিক্ষাকেই পেশা হিসেবে প্রথমে বেছে নিতেন। তাই ভালোমানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া ও একই সঙ্গে শিক্ষকদের মান বাড়ানোর জন্য আমাদের কার্যকর পরিকল্পনা থাকা এবং তার বাস্তবায়ন প্রয়োজন।

শিক্ষাকে কর্মমুখী করার কোনো বিকল্প নেই। দেশের বেকারদের বড় অংশ সনদধারী। এখন দেখা যায়, প্রায় সব বিষয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকার সময় থেকেই বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করে; কিন্তু বিসিএসের আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। ফলে বেকার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সাধারণ বিসিএস-মুখী নিয়োগ না দিয়ে সাবজেক্ট-ভিত্তিক জ্ঞান ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া দরকার। যেমন–কৃষি, অর্থনীতি, পরিকল্পনা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে শুধু যারা এসব বিষয় পড়েন, তাদেরই নেওয়া হবে, তাহলে শিক্ষার্থীরা তাদের বিষয়ে পড়ায় মনোযোগী হবে। যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ ফলিত বিষয়গুলোতে চাকরির সম্প্রসারণ হয়, বাজার ও অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোয় নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে পড়াশোনায় গতি আসবে এবং দেশের শিক্ষার মান বাড়বে।

আমি জানি না, নতুন বছরে সেটি সম্ভব হবে কি না। নির্বাচন আসবে আর ভবিষ্যৎ আশা নিয়ে সুন্দর সুন্দর কথা আমরা শুনব। তবে সেটি কতখানি আন্তরিক সেটিও ভাবার বিষয়। আমাদের শ্রেণিকক্ষকে আরও অনেক বেশি উন্নত করতে হবে। শিক্ষাঙ্গনে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ যেন না থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। দুই বছরের কলেজ শিক্ষায় বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী রাজনীতির শিকার হয়। যারা রাজনৈতিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে তাদের কোনোভাবেই স্থান দেওয়া উচিত নয়। শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতির নামে অপরাজনীতি দূর করতে হবে। আমাদের শিক্ষার শত্রুরা কিন্তু ঘরের ভেতরেই। নোট বই, গাইড বই, টিউশন বাণিজ্য যারা করেন, তারা চাইবেন না যে তাদের ব্যবসা হাতছাড়া হোক। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সংস্কৃতি শিক্ষা, যেটি মানুষকে অগ্রগামী করে। সেই সংস্কৃতি শিক্ষা এবং শিক্ষার একটি আলাদা সংস্কৃতি আছে। দুটির সমন্বয় না ঘটালে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কোনো উন্নতি হবে না। সংস্কৃতিতে আমাদের বেশ জোর দিতে হবে। একটি খেলার মাঠ যদি বিদ্যালয়ে না থাকে তাহলে বাচ্চারা সুস্থ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেড়ে উঠবে না। 

অনেক কিছুরই ব্যাপার আছে, যেগুলো আমাদের ভাবতে হবে। সেগুলো যদি শুরু করা না হয় তাহলে আমরা এগোতে পারব না। আগের সেই মান্ধাতা আমলেই সব চলছে। প্রশাসনে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। কিন্তু এক্ষেত্রে শিক্ষকদের অনেক দূরে রাখা হচ্ছে। অথচ প্রশাসন শিক্ষকদের দ্বারাই শিক্ষিত হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সুনজর না দিলে আমরা আরও পিছিয়ে থাকব। কাজেই সুশিক্ষিত জাতিগঠনে শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন।

লেখক : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036211013793945