শিক্ষা প্রশাসনের কতিপয় বিতর্কিত ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। বদলিকৃতরা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা বোর্ড, নায়েমসহ শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে এসব কর্মকর্তার বদলির আদেশ জারি করা হয়।
এদিকে প্রায় দেড়লাখ কোটি টাকার এসইডিপি প্রকল্পের উপবৃত্তি শাখার উপপরিচালকের পদ বাগাতে জোর লবিং শুরু করেছেন ডিআইএতে চাকরিকালীন নানা অভিযোগে অভিযুক্ত মো: বদরুল আলম ও প্রায় ২০ বছর ধরে ঘুরেফিরে শিক্ষা ভবনেরই বিভিন্ন পদে থাকা সাইফুল নামের দুই কর্মকর্তা। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বদরুল পদটি বাগাতে চায় বলে শিক্ষা প্রশাসনের অনেকে বলাবলি করছেন।
এদিকে বুধবারের বদলির আদেশে অনেকে সন্তোষ প্রকাশ করলেও শিক্ষা প্রশাসনের অতি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে এখনও দুর্নীতিবাজ, প্রশ্নফাাঁসে অভিযুক্ত, মাতাল অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হওয়া, ভিকারুননিসায় অধ্যক্ষ নিয়োগ কেলেঙ্কারি, বউ পেটানো, টাকার বিনিময়ে স্কুল-কলেজের স্বীকৃতি দেয়া, মন্ত্রণালয়কে পাস কাটিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি, ঢাকা বোর্ডের ৮০ কোটি টাকা বেসিক ব্যাংকের বিতর্কিত শাখায় জমা রাখাসহহ বিভিন্ন অভিযোগ অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত আওয়ামী লীগপন্থীরা। তারা শিক্ষা অধিদপ্তর, ডিআইএ, মাদরাসা বোর্ড, পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে দুর্নীতিবাজ ও জামাতপন্থীদের বদলি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে বোর্ডের বাশার ও নায়েমের মাসুদাকে বদলি করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তারা।
জানা গেছে, বদলির তালিকায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান, ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. আবুল বাশার, নায়েমের উপপরিচালক মাসুদা বেগম, মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক মুহাম্মদ নাজমুল হক, শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন ও কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক এ কে এম মাসুদ রয়েছেন। একই আদেশে ১১ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। যদিও অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান ও সহকারী পরিচালক জাকির হোসেনকে নিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে কোন বিতর্ক ছিল না।
সবচেয়ে বিতর্কিতদের একজন নায়েমের উপপরিচালক মাসুদা বেগম ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের আবুল বাশার। তারা শিক্ষা প্রশাসনের কুখ্যাত বাড়ৈ সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে পরিচিত।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নানকে সিলেটের সরকারি এম সি কলেজে বদলি করা হয়েছে। আর চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যাপক মো. বেলাল হোসাইনকে শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক পদে দেয়া হয়েছে। ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ড. আবুল বাশারের প্রেষণ প্রত্যাহার করে তাকে সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়েছে। আর ঢাকা কলেজের অধ্যাপক এস এম আমিরুল ইসলামকে ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক করা হয়েছে। সরকারি বাঙলা কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. সহিদুল ইসলামকে গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে পাঠানো হয়েছে। সহিদুলের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বাড়ৈ সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে।
এদিকে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) উপপরিচালক মাসুদা বেগমকে কুমিল্লার সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে বদলি করা হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের পরিদর্শক মুহাম্মদ নাজমুল হককে টঙ্গী সরকারি কলেজে পাঠানো হয়েছে। নাজমুল হকের বিরুদ্ধে কোনও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. জাকির হোসেনকে সরকারি কবি নজরুল কলেজে সংযুক্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক রুপক রায়কে শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখার সহকারী পরিচালক পদে দেয়া হয়েছে। শিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক এ কে এম মাসুদকে বাহ্মণবাড়িয়া সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয়েছে। সেসিপের সহকারী পরিচালক লোকমান হোসেনকে শিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক করা হয়েছে। তবে, লেকামানের বিরুদ্ধে তদবিরের অভিযোগ রয়েছে।
সহকারী পরিচালক জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে মিথ্যা তথ্য ও বিষোদগার করেছেন ২৪তম বিসিএসের বিতর্কিত নারী কর্মকর্তা ফারহানা বেগম। ফারহানার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকায় তাকে কয়েকমাস আগে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়। এর পরপরই জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে নানা অপ্রচার চালিয়ে আসছেন ফারহানা। এমন কথা গত কয়েকসপ্তাহ ধরে সবার মুখে মুখে ছিল।
বদলিকৃত কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক ছিল নায়েমের উপপরিচালক মাসুদা বেগমকে নিয়ে। কয়েকবছর আগে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে প্রেষণে কর্মরত অবস্থায় মাসুদা বেগমের আর্থিক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা সচিবকে নির্দেশ দিয়েছিলো প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। পুরান ঢাকার আনন্দময়ী বালিকা বিদ্যালয়ের গভর্নিংবডির সভাপতি থাকাকালে আর্থিক দুর্নীতি ও অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ ছিলো মাসুদার বিরুদ্ধে। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তরের এইচআরএম শাখার উপপরিচালক নাসিরকে ধমক দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পক্ষে নেয়ার অভিযোগ মাসুদার বিরুদ্ধে। মাসুদা তখন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেত্রী ছিলেন।
কয়েকবছর আগে ঢাকাবোর্ডে থাকাকালে নিজের মেয়ের জেএসসির ফল পাল্টে দেয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হয় মাসুদার বিরুদ্ধে। ঢাকা বোর্ডে বিভিন্ন অবৈধ বিষয়ে প্রভাব খাটানোরও অভিযোগ ছিল মাসুদার বিরুদ্ধে। এরপরেও বিতর্কিত মাসুদা বেগম মাসের পর মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও নিয়মিত বেতন পেয়েছেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে বদলি করে মাসুদার স্বামীর কর্মস্থলের খুব কাছের বরিশাল বিএম কলেজে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে যাননি মাসুদা বেগম। কয়েকদিনের মধ্যে ওই বদলি আদেশ বাতিল করিয়ে কুমিল্লা সরকারি কলেজে বদলির আদেশ করাতে সক্ষম হন। কিন্তু এই কলেজেও মাসের পর মাস না গিয়ে ঢাকার শিক্ষা অধিদপ্তর ও ঢাকা বোর্ডে ঘোরাঘুরি করেন মাসুদা। এ খবর পৌঁছে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে। দুদক জানতে চায় মাসুদা কলেজে না গিয়েও কেন নিয়মিত সরকারি বেতন-ভাতা উত্তোলন করেন? এতে সরকারের মোট কত লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে? মাসুদাকে নিয়মিত বেতন দেয়ার জন্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কারা দায়ী? ইত্যাদি বিষয় অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিয়ে দুদককে জানাতে বলা হয়। কিন্তু শাস্তির বদলে মাসুদাকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে নায়েমে আনা হয় গত মে মাসে। প্রভাব খাটিয়ে মাসুদা তার স্বামীকে বিতর্কিত ক্যামরিয়ানের একটি শাখায় চাকরি দেন।পরে স্বামীকে তদবির করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্টার পদে চাকরি দেয়া হলেও যৌন কেলেংকারিতে অভিযুক্ত হয়ে চাকরিচ্যুত হন কয়েকমাস আগে।
এত কম সময়ে কেন মাসুদাকে নায়েম থেকে বদলি করা হলো তা জানতে চেষ্টা করেও মাসুদার মতামত পাওয়া যায়নি।
ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বাশারের বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁস, বউকে পেটানোসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। বাশারের মতামত জানতে চাইলেও পাওয়া যায়নি।
জানা যায়, বদলিকৃত কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের শেষ সময়ে নানা অভিযোগে ঢাকার বাইরে বদলি করা হয়েছিল। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পরই তাদের আবার শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের মধ্য থেকে কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও ঢাকার বাইরে বদলি করা হলো। বুধবার বদলি করা কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশ মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) শাহেদুল খবির চৌধুরী ও বিদেশে পলাতক মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈর সমর্থক হিসেবে শিক্ষা প্রশাসনে পরিচিত।