শিক্ষা সংস্কারক আহছানউল্লা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা সংস্কারক আহছানউল্লা

ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত |

আজ ২৬ ডিসেম্বর। রাতের নিস্তব্ধতা এক স্নিগ্ধ চেতনায় মোছা. আমিনা বেগমের স্বপ্ন ভাঙলো; আঁখি মেলে দেখলো তার কোলজুড়ে আছে এক মায়াময়ী চাঁদের টুকরা। কে জানতো এই শিশুটিই একদিন হয়ে উঠবেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক, সমাজহিতৈষী ও সুফি সাধক। তিনি হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি মুসলমানদের অহংকার খান বাহাদুর আহছানউল্লা। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নলতা গ্রামে ধার্মিক, ঐশ্বর্যবান ও দানশীল পিতা মুন্সী মোহাম্মদ মুফিজ উদ্দীনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। 

১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘গ-মিতিয়’ (বর্তমান দ্বিতীয় শ্রেণি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একটি রূপার মুদ্রা পুরস্কার লাভ করেন। এরপর নলতা মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার টাকী গভর্নমেন্ট হাইস্কুল, কলকাতা লন্ডন মিশন সোসাইটি ইনস্টিটিউশন থেকে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে এন্ট্রান্স (এসএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তীতে হুগলী কলেজ থেকে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে এফএ (এইচএসসি) এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সাফল্যের সঙ্গে বিএ পাস করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দর্শন শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে। 

১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে ভারত উপমহাদেশে ইংরেজদের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হলে বাঙালি মুসলমানদের জীবনে নেমে আসে সীমাহীন ছন্দপতন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে এই উপমহাদেশে জমিদারি প্রথা কায়েম হলে মুসলিম রীতিনীতি, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকে।

খান বাহাদুর আহছানউল্লার সুদীর্ঘ কর্মকাল ছিলো প্রবাহমান গতিময়তায় পরিপূর্ণ বর্ণাঢ্য ও সাফল্যের অভাবনীয় সমাহার। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ‘সুপার নিউমারারি’ টিচার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও তার পুরো সময়টাই কেটেছে শিক্ষা বিভাগে। একজন সাধারণ শিক্ষক থেকে শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদে আসন গ্রহণ নিঃসন্দেহে পাহাড়ের শীর্ষ চূড়ায় আরোহণ তার এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ছিলো নানা বৈচিত্রময়তায় সমৃদ্ধ। চট্টগ্রামে চাকরিকালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিসের (আইইএস) অন্তর্ভুক্ত হন। অতঃপর তিনি শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক নিযুক্ত হন এবং বেশ কিছুদিন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা বিভাগের সর্বোচ্চ পদ ‘পরিচালক’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। 

শিক্ষা সংস্কারক খান বাহাদুর আহছানউল্লা শিক্ষা ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান এবং সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং একই বছর ২৮ জুন শিক্ষা প্রসারে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য লন্ডনের ‘রয়্যাল সোসাইটি ফর এনকারেজমেন্ট অব আর্টস, ম্যানুফাকচারার্স অ্যান্ড কমার্স’- এর সদস্য পদ লাভ করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম সিনেট ও সিন্ডিকেট সদস্য নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন; এ সংক্রান্ত একটি খসড়া বিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে উত্থাপিত হলে প্রচণ্ড বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং পরে তা পর্যালোচনার জন্য একটি স্পেশাল কমিটি গঠিত হলে, তিনি ওই কমিটির একজন অন্যতম সদস্য হিসেবে এর আবশ্যকতা সমর্থন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তুতিলগ্নে ড. নাথান কমিশনের মেম্বার ছিলেন এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এক দশকেরও বেশি সময় তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বারের দায়িত্ব পালন করেন। 

শিক্ষা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করলেও এ দায়িত্ব প্রাপ্তিকে তিনি মুসলিম শিক্ষার উন্নতি ও প্রসারের সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং তা কাজে লাগিয়ে মেধা, ধীশক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে মুসলিম শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা ও অনাগ্রহ দূরীকরণ এবং অগ্রগতি সাধনের অনুকূল পরিবেশ তৈরিসহ উচ্চ পর্যায়ের নীতি নির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি তার সৃষ্টিশীল কৌশলে দীর্ঘদিন স্থগিত স্কীমসমূহ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং কলকাতায় মুসলিম ছাত্রদের জন্য একটি স্বতন্ত্র কলেজ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবি সফল করতে সক্ষম হন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ। ইসলামিয়া কলেজ ছাড়াও তিনি বহু স্কুল, কলেজ, হোস্টেল প্রতিষ্ঠা ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। রাজশাহীর ‘ফুলার’ হোস্টেলসহ মুসলিম ছাত্রদের জন্য বেকার হোস্টেল, টেলার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, ও মুসলিম ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত করেন। চট্টগ্রাম মুসলিম হাইস্কুল, মুসলিম এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল গালর্স কলেজ, মাধবপুর শেখ হাইস্কুল ও চান্দিনা পাইলট হাইস্কুল (কুমিল্লা), রায়পুর কে.সি হাইস্কুল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কুটি অটল বিহারী হাইস্কুল ও চৌদ্দগ্রাম এইচ.জে পাইলট হাইস্কুল উল্লেখযোগ্য। 

শিক্ষাক্ষেত্রে তার অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতিত্ব রোধে নামের পরিবর্তে রোল নম্বর প্রবর্তন, মাদরাসা পাস শিক্ষার্থীদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি, সকল স্কুল ও কলেজে মৌলবির পদ সৃষ্টিসহ বেতন বৈষম্য রহিতকরণ, অমুসলিম স্কুলে মুসলিম শিক্ষকের নিযুক্তি ও বিভিন্ন সরকারি বিভাগে মুসলিম কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা, পাঠ্যক্রমে মুসলিম লেখকের পাঠ্য পুস্তক ব্যবহারের প্রচলন ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। 

তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মুসলিম ছাত্রদের আনুপাতিক হারে বৃত্তির ব্যবস্থা, বৈদেশিক শিক্ষার জন্য মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের সাহায্য প্রদানের নিয়ম প্রবর্তন, টেক্সটবুক কমিটিতে মুসলিম সদস্যের অন্তর্ভুক্তি, মুসলিম ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশেষ স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ মুসলিম সাহিত্যের বিপুল প্রসারের ফলে মুসলিম সাহিত্যিকগণ নতুন প্রেরণা লাভ করতে থাকেন; ফলশ্রুতিতে অল্প সময়ের মধ্যে মখদুমী লাইব্রেরি, প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরি ও ইসলামিয়া লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি সমাজ, দেশ, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম, তাসাউফ ও জীবন কথা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে উনআশিটি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন; যা ‘খান বাহাদুর আহছানউল্লা রচনাবলি’ নামে বারো খন্ডে প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ও বহুমুখী অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলা একাডেমি তাকে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে সম্মানসূচক ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করেন। সমাজ সেবা ও সমাজ সংস্কৃতিতে বিশেষ করে দ্বীন প্রচারের কাজে অবদানের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ তাকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে মরণোত্তর পুরস্কারে ভূষিত করেন। 

দৈহিক ক্ষুধার সঙ্গে আত্মিক ক্ষুধার মর্মার্থ অনুধাবন করে তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কর্ম সাধনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চিন্তা ও সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। বিশেষ করে সরকারি চকরি থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ৫৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণের পর থেকে তার এ সাধনার পথ আরো বেগবান হতে থাকে। তিনি ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নলতা আহছানিয়া মিশন’। বর্তমানে দেশে-বিদেশে আহছানিয়া মিশনের প্রায় তিন শতাধিক শাখা- শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পয়ঃনিষ্কাশন, পরিবেশ ও মানব সম্পদ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।

অনগ্রসর বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে খান বাহাদুর আহছানউল্লার আগমণ যেন নক্ষত্রের উদয়। অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ মুসলমানদের শিক্ষা সম্প্রসারণে তার নানাবিধ কল্যাণমুখী ও সুদূরপ্রসারী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ আমাদের জাতীয় গৌরবের অনন্য পটভূমি। প্রায় পুরো এক শতাব্দীকালের সূর্যস্নাত এ মহাপুরুষ পরিণত হন শিক্ষার প্রসার, সংস্কার ও উন্নয়নের মহীরুহে। অব্যাহত জ্ঞান চর্চা, নির্লোভ কর্ম সাধনা এবং বর্ণাঢ্য বুদ্ধিবৃত্তির পরিচর্যার ক্ষেত্রে তার অবদান ছিলো তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে গিরিশৃঙ্গতুল্য। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী অতি সাধারণ হয়েও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের সন্নিবেশ শতাব্দীর এ মহান নকিবের মহৎ কীর্তি বাঙালির হৃদয়ে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুরণিত হবে পরম মমতা ও কৃতজ্ঞতায়। জাতিসত্তার নির্মাণ ও জাতীয় অগ্রগতিতে তার অসামান্য অবদান বাঙালি জাতি আজীবন কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করবে। আজ তার জন্মসার্ধশত বার্ষিকীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: শিক্ষা কর্মী

 

 

ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032360553741455