শিক্ষার মূল মাধ্যম হওয়া উচিত জাতির মাতৃভাষা - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার মূল মাধ্যম হওয়া উচিত জাতির মাতৃভাষা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েই মাতৃদুগ্ধ পান করে জীবনধারণের সঞ্জীবনী শক্তি পায়। দিবারাত্রির-পরিক্রমায় ক্রমান্বয়ে তার বয়স বাড়তে থাকে। শিশু তার পারিপার্শ্বিক আবহ থেকে প্রতি ক্ষণে শুনতে থাকে তার মায়ের ভাষা। কালক্রমে এটিই তার মত ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। জীবনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রকাশের পরিপূর্ণতা আসে মাতৃভাষায়। নিজের আবেগ ও অস্তিত্বের বিশাল একটা অংশ জুড়ে বিরাজমান থাকে ব্যক্তির মাতৃভাষা। জন্মলগ্ন থেকেই মাতৃভাষা মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরা-উপশিরায় মিশে যায়। কোনো চেষ্টা বা মনোযোগ ছাড়াই নিজের অজান্তে অবচেতন মনে মানুষ যে চিন্তা করে তা সংগঠিত হয় মাতৃভাষায়। কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে মাধ্যম যদি হয় মাতৃভাষা, তাহলে সেই শেখাটা পরিপূর্ণতা লাভ করে। মাতৃভাষায় শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নত জাতিগুলো কতটা সচেতন তা নিম্নলিখিত ঘটনার বর্ণনা দ্বারা পুরোপুরি অনুধাবন করা যাবে। সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 


নিবন্ধে আরও জানা যায়, একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের বার্ষিক আলোচনাসভায় আমাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন একজন স্বনামধন্য অধ্যাপক, কলামিস্ট ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। তিনি তার বক্তব্যে মাতৃভাষা নিয়ে ফ্রান্সের মানুষের সচেতনতার কথা তুলে ধরেন। বক্তব্যে তিনি ফ্রান্সের বিখ্যাত লুভার মিউজিয়াম ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। আমরা সবাই জানি, লুভার মিউজিয়ামটি ভাস্কর্য এবং পেইন্টিংয়ের জন্য পৃথিবী বিখ্যাত। অধ্যাপক মহোদয় গিয়েছিলেন ফ্রান্সের সেই মিউজিয়াম পরিদর্শনে। কিন্তু সেখানে সবগুলো দর্শনীয় বস্তুর নিচে লেখা বর্ণনা ফরাসি ভাষায়। ফরাসি ভাষা না জানার কারণে অধ্যাপক মহোদয় ভীষণ অসুবিধায় পড়েছিলেন। এতে তিনি কিছুটা বিরক্তও হয়েছিলেন। অনন্যোপায় হয়ে গুগলের সহায়তায় ইংরেজি করে কিছুটা বুঝলেও তার কাছে বেশির ভাগ বর্ণনাই অজানা থেকে গেল। হোটেলে ফিরে তিনি হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে তার এই অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করলেন এবং বললেন যে, ইংরেজিতে লেখা থাকলে ভালো হতো। কথাটি শুনে ম্যানেজার বললেন, ‘এই ভাষাতে জ্ঞানার্জন করেই আমরা এতটা উন্নতি করেছি। তাই আমাদের প্রজন্মকে ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে দূরে রাখতে চাই না।’ তখন অধ্যাপক মহোদয় ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আপনারা বিশ্বের নতুন সৃষ্ট জ্ঞান কীভাবে গ্রহণ করেন। উত্তরে হোটেল ম্যানেজার বললেন, ‘প্রয়োজনীয় সব নতুন জ্ঞানই আমাদের কাছে অল্প সময়ের মধ্যে ফরাসি ভাষায় মুদ্রিত হয়ে পৌঁছে যায়।’ তিনি মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘জ্ঞান সারা বিশ্বের, কিন্তু তা অর্জনের ভাষা একান্তই আমাদের।’ হোটেল ম্যানেজারের এমন বক্তব্য প্রমাণ করে যে ফরাসিরা নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি দিয়ে কীভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় গ্রহণ করেছে। 

জি-৭ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, ব্রিটেন ও আমেরিকা। দেশগুলোর প্রত্যেকটি কিন্তু তাদের মাতৃভাষায় সর্বস্তরের শিক্ষা গ্রহণ করে। এদের মধ্যে কানাডাতে কুইবেক প্রদেশের মাতৃভাষা ফরাসি এবং অন্টারিও প্রদেশের মাতৃভাষা ইংরেজি। ফরাসি ভাষা অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সবকিছুই কিন্তু ফরাসি ভাষাতে পরিচালনার ব্যবস্থা রয়েছে। এটা কিন্তু উন্নত জাতির একটি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণধর্মী কৌশল। কানাডার সমস্ত জাতিসত্তাকে তারা চাপিয়ে দেওয়া কোনো ভাষায় শিক্ষিত করতে চায়নি। কারণ, তারা জানে শিক্ষার মূল মাধ্যম হওয়া উচিত ঐ জাতির মাতৃভাষা। তবেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা পরিপূর্ণতা পাবে। আলোকপাত করি এশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী তিনটি দেশের ওপর। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, চায়না।

দেশ তিনটি প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরেই মাতৃভাষার ব্যবহার সমুন্নত রেখেছে। ফলে শিল্প, গবেষণা ও জাতিগত সাংস্কৃতিক ও নৈতিক গুণাবলি অক্ষুণ্ন রাখতে তাদের কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। শিল্প, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক গুণাবলি সমুন্নত রাখার শেকড়ের যে শক্তি তা হলো বিজ্ঞানবিষয়ক শিক্ষা, গণিতের পারদর্শিতা এবং জাতিসত্তার আবেগীয় অনুভূতিগুলোর সর্বোচ্চ অনুশীলন। এগুলো তখনই সম্ভব হয়, যখন মানুষ তার ভাষা এবং সংস্কৃতিকে লালন করে এবং শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের মাতৃভাষার প্রয়োগ ঘটায়। মাতৃভাষায় শিক্ষার সুবিধা হলো মানুষের অবচেতন মন ঘুমের ঘোরেও শিক্ষাকে চলমান রাখে। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মকানুন মেনে কোনো অতিরিক্ত চেষ্টা করার দরকার হয় না। এশিয়ার যে তিনটি দেশের কথা উল্লেখ করেছি অর্থনৈতিক উন্নয়নে এরা অপ্রতিরোধ্য। আমাদের ধারণা, ইংরেজিতে লেখাপড়া না করলে প্রতিযোগিতার বিশ্বে আমরা পিছিয়ে পড়ব। কিন্তু ইউরোপের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখি এক ব্রিটেন ছাড়া সবারই ভাষা ভিন্ন এবং তাদের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা নিজ মাতৃভাষায়। শিক্ষাকে মাতৃভাষায় পরিচালিত করার জন্য যা দরকার, তা হলো পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডারের মানসম্মত অনুবাদ। এই অনুবাদগুলো বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থাগুলো করে থাকে। প্রকাশনা সংস্থাগুলো বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বই মুদ্রিত করে।

বর্তমান পৃথিবীর বিগ ডাটা নিয়ে গবেষণার জন্য পাইথন নামে যে অ্যাডভান্স কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার আবিষ্কারক কিন্তু কোনো ইংরেজি ভাষাভাষী ব্যক্তি নন। তিনি একজন ডাচ নাগরিক। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, মাতৃভাষা গবেষণার উন্নয়নে মূল চালিকাশক্তি। গবেষণাকে হূদয়ের গভীরে বপন করতে হলে চাই অবচেতন মনেও তা নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা। মাতৃভাষায় গবেষণা গ্রন্থ ও নিবন্ধগুলোর সহজ ও সাবলীলভাবে বিদেশি ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা এবং বিদেশি ভাষায় লেখা জ্ঞানকে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করার ব্যবস্থা থাকলেই গবেষণা ও শিল্পের উন্নয়ন একটি উচ্চ মাত্রায় পৌঁছাবে। এজন্য বহুপক্ষীয় ভাষায় অনুবাদের কলাকৌশল নিয়ে গবেষণার জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে। যে প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি জ্ঞানকে আমাদের ভাষায় আর আমাদের গবেষণাকে বিদেশি ভাষায় রূপান্তরের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে।

চীনের জনসংখ্যা ১৩৯ কোটি এবং তার প্রতিবেশী দেশের জনসংখ্যা ১৩২ কোটি। পড়ুয়া জাতির সূচকে পৃথিবীতে এক নম্বরে রয়েছে ভারত এবং তিন নম্বরে চীন। কিন্তু চীন তার সর্বস্তরের শিক্ষাকে নিজ ভাষায় গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে ভারত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের ধারাবাহিকতায় উচ্চশিক্ষাকে ইংরেজি মাধ্যমে রেখেছে। দেশ দুটির অর্থনৈতিক, গবেষণা এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের পার্থক্য চোখে পড়ার মতো। পড়াশোনায় সময় বেশি দিয়েও ভারত পিছিয়ে পড়েছে কেন? আমার বিবেচনায় চীন মাতৃভাষায় সর্বস্তরের শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার কারণে সব মানুষের জন্যই গবেষণা ও উদ্ভাবনকে সহজ থেকে সহজতর করতে পেরেছে। ভাষার কারণে তাদের ক্ষেত্রে জ্ঞানের চর্চায় জনগণের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। তাই উচ্চশিক্ষার মাধ্যম মাতৃভাষা হলে জনগোষ্ঠীর সিংহভাগের অন্তর্ভুক্তি সম্ভব যে কোনো জ্ঞান চর্চা ও গবেষণায়। গবেষণার উন্নয়ন অর্থ জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়ন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি মানে শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন। বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেই ঘটবে জাতির অর্থনৈতিক ও নৈতিক উন্নয়ন।

 

লেখক : ড. মো. নাছিম আখতার, উপাচার্য, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0068528652191162