শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলনে নামে বুঝতে হবে গলদ আছে : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষার্থীরা যখন আন্দোলনে নামে বুঝতে হবে গলদ আছে : সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

যখন একটি দেশের স্কুলপড়ুয়া, এসএসসি পরীক্ষার্থী বা সমপর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ‘রাষ্ট্রের মেরামত চাই’- এমন দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে তখন বুঝতে হবে, সত্যিকার অর্থে কোথাও গলদ আছে। সরকার বলছে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তাহলে এই শিক্ষার্থীদের তো রাস্তায় বেরিয়ে আসার কথা ছিল না। এই চিন্তা কেন সরকারের মাথায় আসে না যে, ছাত্ররা যখন রাস্তায় নেমেছে নিশ্চয়ই তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কারণেই তা তারা করছে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে গতকাল এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, গলদটা কোথায়? গলদটা আমাদের সড়ক ব্যবস্থাপনায়, আমাদের পরিবহন খাতে। এই দুই ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎমুখী দৃষ্টিভঙ্গি না থাকার মধ্যে। আমাদের সড়ক পরিবহন খাতটি পুরোটিই ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ করেন। এই নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে আর নেই, যদিও এই ব্যবসায়ীদের অনেকে সরকারি দলের সঙ্গে যুক্ত। বেসরকারি বাস মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের বাধার মুখে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) কর্তৃপক্ষ অনেক রুটে বাস চালাতে পারে না। সাধারণ বিবেচনা বলে, একজন শ্রমিক নেতা সরকারবিরোধী অবস্থান নিলে তিনি সরকারের ভিতরে অবস্থান করতে পারেন না। অথচ পরিবহন শ্রমিক নেতারা সরকারের মন্ত্রীও হন এবং এমপিও হন। সরকারের সঙ্গে শ্রমিক নেতারা যেখানে দাবি আদায়ে বৈঠকে বসেন, তারা জনগণের দাবির বিপক্ষে গিয়ে, সরকারের অবস্থানের বিপক্ষে গিয়ে নানান দাবি তোলেন। দিন শেষে সরকারও তা মেনে নেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অর্থাৎ ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’ বলে একটা কথা আছে, আমাদের দেশে সেটি মানা হচ্ছে না। আর এ জন্যই সব লেজেগোবরে হয়ে যায়। সোমবার (২৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রক্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ছাত্ররা যখন রাস্তায় নামছে তখন সরকারের পরিষ্কার ধারণা হওয়া উচিত ছিল যে, নিশ্চিতভাবেই কোথাও কোনো গভীর সমস্যা আছে। এই শিক্ষার্থীরা তো কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়, সে অর্থে রাজনীতি নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই, যে অর্থে সেই পাকিস্তান আমলে আমাদের ছিল। আমরা তখন একটি নতুন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলাম। কাজেই আমরা যখন ছাত্র ছিলাম প্রত্যেকেই রাজনীতিসচেতন ছিলাম। এখন তো সেই অবস্থা নেই। সরকার বলছে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তাহলে এই শিক্ষার্থীদের তো রাস্তায় বেরিয়ে আসার কথা ছিল না। এই চিন্তা কেন সরকারের মাথায় আসে না যে, ছাত্ররা যখন রাস্তায় নেমেছে নিশ্চয়ই তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার কারণেই তা তারা করছে। এর কারণও খুব স্পষ্ট। তাহলে সরকারের তরফ থেকে কোনো সাড়া নেই কেন? শিক্ষার্থীরা যখন ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে তখন তাদের দাবি ছিল একটাই, নিরাপদ সড়ক চাই। অথচ তাদের দাবিগুলো তো মানা হলোই না, বরং কাগজে-টিভিতে দেখা গেল, তাদের হেলমেট নাকি হাতুড়ি বাহিনী হামলা করল। এই হামলাকারীদের কাউকে ধরা হলো না, যে অপরাধ তারা করল, তার বিচার হওয়া তো দূরের কথা। আর আমাদের দেশে সরকারের ছাত্র সংগঠনগুলোর একটা বড় কাজই হলো সরকারের বিরুদ্ধে যেই রাস্তায় নামুক তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বে যারা আছে তাদের ছাত্রত্ব বহু আগেই শেষ হয়েছে। এদের কেউ কেউ ব্যবসায়ী অথবা চাকরিজীবী। ফলে এই ছাত্রনেতাদেরও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রতি কোনো দরদ নেই। তাদের মৌখিক দরদ থাকেলেও ভিতরে তা নেই। আর ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা না থাকায় ছাত্রদের তরফ থেকে যে আন্দোলন হয়, তার প্রয়োজন বা উত্তাপ তারা উপলব্ধি করতে পারে না। শিক্ষার্থীদের পক্ষে অন্য ছাত্র সংগঠনগুলো সংঘবদ্ধ ভূমিকায় নামছে না। কিছু দিন আগে বদরুন্নেসা কলেজের এক মেয়ে শিক্ষার্থী যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে আমার ধারণা ছিল সব শিক্ষার্থী এবং ছাত্র সংগঠন এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসবে। কিন্তু দেখলাম যে, সব মহলে একে খুব সাধারণ বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। এটি যে অত্যন্ত নিন্দনীয়, অসাংস্কৃতিক এবং একটি অপরাধমূলক কাজ সেই বিবেচনাটাই এলো না।

এই শিক্ষাবিদ বলেন, সরকারকে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে আজ যে দাবি শিক্ষার্থীরা তুলেছে এটি তাদের প্রাণের দাবি। এই দাবি মেটানো খুব কঠিন কিছু না। দেশের বড় প্রকল্পগুলোতে প্রচুর অর্থ দেওয়া হচ্ছে। অনেক প্রকল্পে টাকার নয়-ছয় হচ্ছে। এ প্রকল্পগুলোর ব্যয়ও বারবার বৃদ্ধি করা হচ্ছে। এর কারণ কি সেটা আমরা জানি না। ব্যাংক লুট হচ্ছে। স্বচ্ছতার বড় অভাব আমাদের দেশে। ব্যাংক সেক্টরের এক লোক বাংলাদেশ থেকে যে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়ে চলে গেলেন, সেই টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাস ভাড়ায় বহুদিন ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব। সরকারের উচিত হবে এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা। এ জন্য প্রয়োজনে বিআরটিসিকে আগের মহিমায় ফিরিয়ে আনতে হবে। সিঙ্গাপুরে সব সরকারি বাস। অথচ সব চলছে যথানিয়মে। তাহলে, হয় বেসরকারি খাতকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে বিআরটিসিকে দিয়ে সেবা দেওয়া হোক, অথবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে পরিবহন চললে বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলোকে সব নিয়মনীতি মানতে বাধ্য করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে সরকারি দলের ভিতরেই বাস মালিকরা আছেন। আগেও ছিলেন, এখনো আছেন। আর এই মালিকরা যদি সরকারি সিদ্ধান্তই না মানেন আর সরকার তা মেনে নেয় তাহলে বুঝতে হবে তাদের প্রতি সরকারের সমর্থন আছে। এই কথাসাহিত্যিক বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে ভর্তুকি পাকিস্তান আমলেও দেওয়া হতো। আমরা পাকিস্তানিদের তাড়িয়ে দিয়েছি, কিন্তু এই চর্চা স্বাধীনতার পরও ছিল। ধীরে ধীরে তা উঠে গেছে। আর মুক্তবাজার অর্থনীতির সব নীতি মেনে আমরা এই শিশুদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দিলাম। তিনি বলেন, একটা সমাধান হতে পারে সরকার বেসরকারি বাস মালিকদের কিছু ভর্তুকি দেবে এবং বাস মালিকদেরও কিছু ভর্তুকি দিতে হবে। এই যে বাস মালিকরা এখন ১০ টাকার জায়গায় ভাড়া ঠিকই ১৫ টাকা নিচ্ছেন এতে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এই যে যাত্রীদের থেকে তারা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন এর একটা অংশ দিলেই শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হয়। সমস্যা হচ্ছে, আমরা এমন এক লোভের সংস্কৃতিতে পড়ে গেছি যে, নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আমরা কিছু করছি না বরং আমাদের কী হবে এটাই এখন প্রধান চিন্তা। আমার মতে, চলমান আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের যে দাবি তা অযৌক্তিক না। আমি প্রস্তাব করছি, অন্তত শিক্ষার্থীদের ক্লাসের সময়ে তাদের হাফ পাস দেওয়া হোক। সন্ধ্যায় এর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা-৬টা পর্যন্ত হাফ পাস সুবিধা পাবে। কিছু দিন আগে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে ভাড়ার বিষয়ে সরকারের বৈঠক হলেও সেখানে এ বিষয়টি আলোচনাতেই আসেনি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগ বা সরকারি দলের যে রাজনীতি এখন চলছে সেখানে এককালে যারা ছাত্র রাজনীতি করতেন তাদের অবস্থান অত্যন্ত গৌণ হয়ে গেছে। এখন প্রধান অবস্থানে তারাই চলে আসছেন যারা ব্যবসায়ী, যারা মাঠে কোনো দিন কাজ করেননি এবং ছাত্র সমাজের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এরা ছাত্রদের দাবি-দাওয়া বুঝবেন না। চলমান ছাত্র আন্দোলনটি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে একে তারা ক্ষতিকর ভাববেন। অথচ আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভিত্তি গড়ে দিয়েছে ছাত্র আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবসময় ছাত্রদের দাবি মেনে নিতেন। কিন্তু এ দাবিগুলো ক্রমান্বয়ে কমতে কমতে এখন ব্যবসায়ী নেতারা যে দাবি তুলে ধরেন সেসবই মেনে নেওয়া হয়। ছাত্রদের কোনো রকম ভূমিকা এখানে এখন নেই। এতে আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ এটা বুঝলেও চুপ করে আছেন। শিক্ষার্থীরা যদি সত্যিকার অর্থে পথে নামে তাহলে সেটি সামাল দেওয়া মুশকিল হবে। কারণ তাদের পিতা-মাতা সব দলের এবং মতের মানুষ। বিএনপি পথে নামলে যে কোনোভাবে দলটির নেতা-কর্মীদের মোকাবিলা করা যাবে। কিন্তু ছাত্ররা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে নামে তখন যেমন দমন-পীড়ন করা যাবে না, আবার তাদের দাবি মেনে নিলে সরকারি দলের পরাজয় হয়েছে- বিরোধী দল এমন কথা বলার সুযোগ নিতে পারে। আবার যে বিরোধী দল সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রকম আন্দোলন করে সুবিধা নিতে পারছে না, তারাও নিজেদের স্বার্থে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন কাজে লাগাবে। এতে অবস্থা আরও ঘোলাটে হবে।

লেখক : ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0080749988555908