শিষ্টাচারের কানাগলি - দৈনিকশিক্ষা

শিষ্টাচারের কানাগলি

মোস্তাফিজুর রহমান শামীম |

আমরা যখন স্কুল কলেজের ছাত্র ছিলাম, তখনও স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতাম। প্রাইভেট পড়া আসলে একটা তৃপ্তিদায়ক ব্যাপার। প্রাইভেট না পড়লে মনে হতো পড়াশোনা আর হচ্ছে না। প্রাইভেট পড়েও যে অনেক কিছু উদ্ধার করে ফেলতাম ব্যাপারটা তাও না। আমাদের স্যাররা সেই সময়ে ৮ থেকে ১০ জনের বেশি পড়াতেন না। কোনো কোনো স্যার ৫ জনের বেশি পড়াতেন না। স্যারকে স্কুলেও যেমন ভয় পেতাম, প্রাইভেটেও ঠিক একই রকম ভয় পেয়েছি। কারণ স্যার তার মূল্যবোধ ও ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে খুবই সজাগ থাকতেন। প্রাইভেট পড়তাম বলে কোনো অতিরিক্ত ফয়দা হয়নি। বকতেন, মারতেন আবার স্নেহ করতেন। এমনই ছিলেন নব্বইয়ের দশকের শিক্ষকরা। 

যুগ বদলে গিয়েছে, প্রাইভেট পড়ানোর ধারাও পাল্টে গেছে। একই ব্যাচে আগে যেখানে ১০ জন পড়ানো হতো, এখন সেখানে ৫০-৯০ জন প্রাইভেট পড়ানো হয়। দেশের অনেক স্কুল-কলেজে একটি শ্রেণিকক্ষেও এতো শিক্ষার্থী থাকে না। যে শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান, তিনি এখন খুবই কমার্শিয়াল। অনেকেই ভর্তি ফিস নেন। অগ্রিম বেতন নেন। এরপরও থাকে ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ম। অর্থাৎ তাদের মধ্যেও গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। পড়লে সিন্ডিকেটের সবার কাছেই পড়তে হবে, না পড়লে নেই। শিক্ষার্থীদের একরকম বাধ্য হয়েই প্রয়োজন না থাকলেও সব সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়তে হয়।

আমরা সবাই জানি প্রাইভেট কেন প্রয়োজন। মূলত একজন শিক্ষার্থী যদি নিজেকে কোনো বিষয়ে প্রয়োজনের চেয়ে দূর্বল মনে করে, তখন প্রাইভেট শিক্ষকের শরণাপন্ন হতে হয়। কিন্তু চিত্র এখন বিচিত্র। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী কাগজে কলমে শুধু একটি পরিচয় অর্জন করা ও পরীক্ষা দেয়ার জন্য স্কুল কলেজে যায়। আর শিখতে যায় প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে। 

প্রাইভেট ছাত্রছাত্রী ধরে রাখার জন্য চলে প্রাইভেট শিক্ষকদের নানা কর্মযজ্ঞ। প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীদের লেকচার শিট প্রদান করা হয়। ভালো উদ্যোগ। তবে ব্যতিক্রম নয়। কারণ ওই লেকচার শিটের কম্পোনেন্ট সব বইয়ের মধ্যেই থাকে। এখানে শিক্ষকদের বিশেষ কোনো ইনোভেশন নেই।

প্রাইভেট পড়া এখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। জন্মদিন পালন, অমুক ডে, তমুক ডে পালন, আড্ডা, গল্প, শিক্ষকের সাথে ইয়ার্কি, হাসি, তামাশা এসব এখন প্রাইভেটের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাকরণ। এই সমাজে এখন এমন জোকার স্বভাবের মানুষের প্রাধান্যই বেশি। তাদের মতে, এসব প্রশ্রয় না দিলে ছাত্রছাত্রী থাকে না। প্রাইভেট শিক্ষকদের সাথে ছাত্রছাত্রীরা এতো বেশি ফ্রি হয়ে যায় যে, তারা নিজেদের শিক্ষকদের সম্মানের বিষয়টি ভুলে যায়। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, শিক্ষক বন্ধুসুলভ হতে পারে, কিন্তু বন্ধু হতে পারে না। 

শুধু তাই নয়, প্রাইভেট পড়ানোর সময় চলে পরচর্চা ও পরনিন্দা। প্রাইভেট শিক্ষক তার ব্যক্তিগত ঈর্ষা ছাত্রছাত্রীদের মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে দেন। অর্থাৎ অন্যান্য শিক্ষক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দিয়ে দেন ছাত্রছাত্রীদের মাঝে। নিজের মধ্যে হিরোইজম প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। প্রতিষ্ঠানের বাকি শিক্ষক সম্পর্কে ভুলভাল ধারণা মাথায় রেখে দেয় শিক্ষার্থী। ফলে ওই শিক্ষকদের সাথে শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায় বটে। 

প্রাইভেট শিক্ষকরা নিজেদের সবসময়ই সুপিরিয়র মনে করেন। যার কাছে যতো বেশি ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট পড়ে, তিনি নিজেকে ততো বেশি সুপিরিয়র মনে করেন। বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, পাগলের সুখ মনে মনে। এই কথাটাই এই মূহুর্তে মনে পড়ল। তারা নিজেদের যাই মনে করুক এই সমাজ প্রাইভেট শিক্ষক, লজিং টিউটর, হাউস টিউটর, গাড়ির ড্রাইভার, বাড়ির কেয়ারটেকার সবাইকে একই দৃষ্টিতে দেখে। যা প্রাইভেট শিক্ষকদের কখনও মাথায়ই আসে না। আসলেও কোনো কিছুই যায়-আসে না।  

হ্যাঁ, আপনারা বলবেন, আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়াতে হয়। বর্তমানে শুধু বেতনের টাকায় পুরো মাস পার করা প্রত্যেক শিক্ষকের জন্যই কঠিন। আপনাদের সাথে আমিও একমত। আমার মূল বক্তব্য আসলে প্রাইভেটের বিরুদ্ধে নয়। আমার বক্তব্য লাগামহীনভাবে প্রাইভেট পড়ানোর বিপক্ষে। তাদের এইরকম উম্মাদ আচরণ ছাত্রছাত্রীদের ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে শিষ্টাচার, মূল্যবোধ, নৈতিকতা। আদব কায়দা শেখার পরিবর্তে একেকটি ছাত্র একেকটি বেয়াদব তৈরি হচ্ছে। 

প্রাইভেট শিক্ষকদের কিছু ছাত্রছাত্রী প্রতিবছর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যালে চান্স পান। এটা অস্বীকার করব না। কিন্তু চান্স আসলে কারা পাচ্ছেন? যারা আগে থেকেই ভালো স্টুডেন্ট, নিজেই নিজের ভালো বোঝেন, নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া করেন, তারাই চান্স পান। ভালো স্টুডেন্ট ভালো করবেন এটাই স্বাভাবিক। এখানে প্রাইভেট শিক্ষকের ক্রেডিটের কিছু দেখি না। হ্যাঁ, একজন দুর্বল স্টুডেন্ট যদি তার কাছে প্রাইভেট পড়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারে, সেক্ষেত্রে আমি বলব প্রাইভেট স্যারের কিছুটা ক্রেডিট রয়েছে। বাকিটা ঐ শিক্ষার্থীর আত্মচেষ্টায় হয়েছে।  

ছাত্রজীবনে যারা প্রাইভেট পড়ায় তারা অনেক কিছু শিখতে পারে, জানতে পারে। প্রাইভেট, কোচিং তো তাদের তাদেরই হওয়া উচিত ছিল। তারা তো বেকার। তারা যদি প্রাইভেট, কোচিং করিয়ে নিজেদের লেখাপড়ার খরচ চালায়, তাহলে আমার আপনার ক্ষতি কোথায়? আমার আপনার তো একটা চাকরি আছে। বেতন আছে। ওদের সেটা নেই। প্রাইভেট কোচিং বেকারদের আয়ের একটি উৎস। যদিও তা চিরস্থায়ী নয়। প্রাইভেট কোচিং কোনো পেশার মধ্যেও পড়েনা। স্কুল-কলেজের বেতনভুক্ত শিক্ষকদের নিয়ম বজায় রেখে প্রাইভেট পড়ার ব্যাপারে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে একটি আইন প্রণয়ন হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন একেবারেই নেই। একই শিক্ষক ক্লাসে একরকম পড়ান, আর প্রাইভেটে অন্যরকম পড়ান। এমন কেন হয়? এর অর্থ আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গাটি খুবই দুর্বল।  

সাম্প্রতিককালে দুটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। একজন শিক্ষককে তার ছাত্র হত্যা করেছে। আরেকজন শিক্ষককে সারাদেশের চোখের সামনে লাঞ্চিত করা হয়েছে। সারা দেশ বলব, কারণ যখন এমন ঘটনার ভিডিও সারা দেশের মানুষ দেখে, তখন এটা নির্দিষ্ট এলাকার ইস্যু থাকে না। একজন শিক্ষক জীবনে সবচেয়ে বেশি যা পান, তা হলো সম্মান। এই সম্মানটুকুই তার জীবনের সম্বল। শিক্ষার্থীদের আচরণ দিনের পর দিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। পারিবারিক শিক্ষার অনেক বড় অভাব দেখা দিচ্ছে। অভিভাবকগণ এর দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না। 

প্রাইভেট শিক্ষকগণও এর দায় এড়াতে পারেন না। তারা প্রাইভেট পড়াবেন। বললেও পড়াবেন, না বললেও পড়াবেন। করোনায় লক ডাউনেও তারা এ অভ্যেস ছাড়তে পারেননি। এতে আমার মাথাব্যথা নেই। কিন্তু প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবসা প্রসারের জন্য দয়া করে শিক্ষার্থীদের মাথায় তুলে দেবেন না। নিজের ব্যক্তিত্বের জায়গাটি অন্তত ঠিক রাখুন। অনুরোধ জানাচ্ছি, আপনি ক্লাসে ও প্রাইভেটে একই রকম শিক্ষক হওয়ার চেষ্টা করুন। প্রাইভেট ছাত্রছাত্রীদের অনেক বেশি প্রশ্রয় দেয়ার প্রভাব গোটা শিক্ষক সমাজের ওপর পড়ছে। ভুলে যাবেন না, এর কঠিন ফল আপনাকেও ভোগ করতে হতে পারে। 

লেখকঃ মোস্তাফিজুর রহমান শামীম, সহকারী অধ্যাপক (ইংরেজি), ভেড়ামারা সরকারি কলেজ।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043470859527588