করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের সর্বপ্রান্তে। এটি এমনই এক ছোঁয়াচে রোগ যে আপনি নিজে সচেতন হলেই হবে না, আপনার আশপাশের প্রত্যেক মানুষকেই করোনা প্রতিরোধে সমান সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। কিন্তু সরকারের এত নির্দেশনা সত্ত্বেও বাজারে বা রাস্তায় বের হলেই মনে হচ্ছে বাংলাদেশে করোনা বলতে কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবে দেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষ এবং মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাঝে কিছুটা মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস পেলেও বর্তমানে সেটা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। টেস্ট, শনাক্ত এবং মৃত্যুর হার বিশ্লেষণ করলে সেটা উপলব্ধি করা যায়। সোমবার (২২ জুন) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপ-সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, করোনা যুদ্ধে প্রথম সারিতে কাজ করছেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। এ দুঃসময়ে তাঁদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে যাচ্ছেন। আমি নিজেও শুরু থেকেই জনসচেতনতামূলক কাজ করেছি এবং এখনো করে যাচ্ছি। করোনায় অনেক মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে। কারণ সংক্রমণের ভয়ে অনেক হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে চায়নি। অনেক মানুষের হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে। এসব ঘটনা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। কারণ করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এবং দিন দিন স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে উঠছে। কবিড-১৯ চিকিৎসায় বেসরকারি হাসপাতাল যে হারে ফি নিচ্ছে তা সাধারণ নিম্নবিত্তের পক্ষে তো অকল্পনীয় বটেই, আমাদের মতো শিক্ষকদের পক্ষেই সে ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। আমাদের আয় সীমিত এবং এই জন্য দরকার সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল।
আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল সেন্টার আছে। কিন্তু তা কভিড চিকিৎসার জন্য একেবারেই উপযোগী নয়। এগুলো নামেই আছে, কাজেকর্মে নেই বললেই চলে।
আমাদের দেশে যেভাবে হাসপাতাল গড়ে উঠছে তা আমরা সবাই অবগত। আপনি নিজে ইচ্ছা করলেও ভালো চিকিৎসা নিতে পারবেন না। হাসপাতালের উদ্দেশ্য হওয়ার কথা ছিল মানুষকে সেবা দেওয়া। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটা বাস্তবতা যে বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেবার নামে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন চিকিৎসার ফির নামে নিয়ে যাচ্ছে। জাতির এই দুর্দিনেও তারা সেটা অব্যাহত রেখেছে।
এই মুহূর্তে যদি আমাদের প্রতিটি পেশার জন্য সেই পেশার উদ্যোগে পেশাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপক ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তাহলেই কিন্তু সরকারের ওপর চাপ কমত এবং সাধারণ নাগরিকরা সরকারি হাসপাতাল থেকে বেশি চিকিৎসাসুবিধা পেত। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি পেশায়ই পেশাজীবীদের বড় বড় সংগঠন আছে। তারা নিজ নিজ পেশাজীবীদের সমন্বিত কভিড চিকিৎসার জন্য কিছু ভাবছে কি? সবাই যদি সরকারের ওপর নির্ভরশীল থাকি, সরকারের পক্ষে সর্বদা ভালো সেবা দেওয়া কঠিন হবে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়ে সম্মিলিত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার জন্য এখনই ভাবতে হবে।
বাংলাদেশে অনেক পেশার লোকদের চিকিৎসার জন্য নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে, যেমন—সামরিক হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল। আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। এ ছাড়া তারা অন্যান্য হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সুব্যবস্থা করছে। সুতারং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বে যেকোনো ভালো হাসপাতালের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি থাকা উচিত বলে মনে করি। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তাঁরা সেখানে যেন চিকিৎসা নিতে পারেন। উদ্যোগ এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিলে এটা সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যদের জন্য সামরিক হাসপাতালের ন্যায় সম্মিলিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল স্থাপন এখন সময়ের দাবি। সম্মিলিত হাসপাতাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের এবং শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করবে।
সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল চালু করার জন্য প্রথমেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় বা দেশের যেকোনো সুবিধাজনক স্থানে নির্ধারিত ডাক্তার ও জনবলের সমন্বয়ে প্রচলিত ল্যাব ও অন্যান্য প্রযুক্তিসংবলিত ব্যবস্থার উদ্যোগ নিতে হবে। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন তাঁদের সবাইকে কল্যাণ তহবিলে নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা রাখতে হয়। আমাদের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের কল্যাণ ফান্ড থেকে টাকা কেটে প্রতি মাসে অনেক বড় তহবিল গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অর্থায়ন করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীরাও নির্দিষ্ট হারে প্রতি সেমিস্টারে ছয় মাস অন্তর চিকিৎসা ফি বাবদ টাকা দেবে, যা দিয়ে সম্মিলিত বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল স্থাপনের জন্য বড় ফান্ড তৈরিতে সহায়তা করবে। পরে আমরা চিকিৎসা গ্রহণের সময় টাকা দিয়ে চিকিৎসা নিতে পারব। কিন্তু ফির পরিমাণ কম হবে। এর উদ্দেশ্য হবে চিকিৎসার জন্য হয়রানি দূর করা। ওই হাসপাতালে আমরা যাতে সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারি। প্রয়োজনে সাধারণ মানুষও চিকিৎসা নিতে পারবে। কিন্তু অগ্রাধিকার পাবেন বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্যরা।
আমাদের মূল লক্ষ্য হবে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা, যাতে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কোনো সদস্যকে বিনা চিকিৎসায় মারা না যেতে হয়। আমি জনৈক এক প্রকৌশলী এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল স্থাপনসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয় করতে গেলে আনুমানিক ২০০ বা ২২৫ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। সেই লক্ষ্যে নিম্নলিখিত উপায়ে তহবিল গঠন করে সম্মিলিত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, ২০১৮ সালের তথ্য অনুসারে আমি এখানে ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবেচনা করেছি। কিন্তু বর্তমানে ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বাজেট থেকে গড়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় চার কোটি টাকা দিলে ১৪৮ কোটি টাকা হয়।
আমাদের চিকিৎসার লক্ষ্যে সম্মিলিত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার মতো উদ্যোগ অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আজকে যদি আমাদের নিজস্ব হাসপাতাল থাকত, তাহলে করোনার সময়ে অন্তত মনে সাহস পেতাম যে করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাব। এভাবেই প্রতিটি পেশা যেমন—সাংবাদিক, ব্যাংকারসহ অন্যদের পেশাভিত্তিক হাসপাতাল স্থাপন করা প্রয়োজন। তাহলে সরকারের ওপর চাপ কমবে। যেকোনো মহামারি মোকাবেলা সহজ হবে এবং সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে। তাতে সরকারি হাসপাতাল থেকে সাধারণ নাগরিকরা বেশি চিকিৎসা সুবিধা নিতে পারবে।
এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার অনেক উপকৃত হবে এবং সেই সঙ্গে নতুন যেকোনো সংক্রমণের ঝুঁকিতে আমরা নিজেরাসহ অন্যদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করি। এখন গণপরিবহন চালু হওয়ায় করোনার ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। দেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার পরও করোনাভাইরাসের বিস্তাররোধে এখন আমাদের সবাইকে আত্মসচেতন হতে হবে। তাই যত দিন না পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রকে কভিড-১৯-এর প্রাথমিক চিকিৎসার উপযোগী করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। করোনার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক খাতের টাকা খরচ হয়নি। ওই টাকা দিয়ে চিকিৎসা সরঞ্জামদি ক্রয় করে চিকিৎসাকেন্দ্রে অক্সিজেন সরবরাহসহ অন্যান্য ফ্যাসিলিটি নিশ্চিত করাও এখন জরুরি দরকার। আশা করি আমাদের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে অতিসত্বর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সার্বিক স্বাস্থ্য নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমন্বিত হাসপাতাল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হবেন। এ কাজটি যাঁরা করবেন, শিক্ষকসমাজ তাঁদের আজীবন স্মরণ করবে।
লেখক : মো. শফিকুল ইসলাম, শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।