সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই - দৈনিকশিক্ষা

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি দুটির একটি ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অপরটি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই। পেছনে ফিরে তাকালে প্রশ্ন উঠতে পারে, দুটি দাবি কেন তোলা হলো, একটিই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয় তাহলেও সর্বস্তরে তার যে প্রচলন ঘটবে কি, ঘটবে না, সে বিষয়ে কোনো সংশয় ছিল কী? জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ, ছিল। প্রথমত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে- এমন দাবি পূর্ববঙ্গের মানুষ তোলেনি, তারা চেয়েছে বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ দুটির একটি; তাই বাংলাকে যদি রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে মেনে নেয়াও হয় তাহলেই যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হয়ে যাবে এমন ভরসা কোথায়? ভরসা নেই বলেই বোধ হয় রাষ্ট্রভাষা দাবির সঙ্গে বাংলা প্রচলনের দাবিটাও উঠেছিল। বৃহস্পতিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরো জানা যায়, অখণ্ড পাকিস্তানে বাংলাকে শেষ পর্যন্ত অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছিল; কিন্তু নতুন জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ বাঙালি ওই মেনে নেয়াতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। যে জন্য ধাপে ধাপে এগিয়ে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রয়োজনে তারা এমন একটি রাষ্ট্রই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যার অন্যতম নয়, একমাত্র রাষ্ট্রভাষাই বাংলা। কিন্তু তারপরে? বাংলা কি সর্বস্তরে প্রচলিত হয়েছে? হয়নি যে সেটা তো পরিষ্কার।

ছবিটা আমাদের সবারই জানা। তবু তার দিকে চকিতে তাকানো যেতে পারে। বাংলা উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হয়নি। তদুপরি শিক্ষা তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। তিনটির মধ্যে যে ধারাটি ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে এবং যার ভেতরে থেকে বিত্তবান পরিবারের সন্তানেরা লেখাপড়া করছে এবং আগামী দিনে যে ধারায় শিক্ষিতরাই সমাজে কর্তৃত্ব করবে বলে ধরে নেয়া যায়, সেই ধারাটির মাধ্যম অবশ্যই বাংলা নয়। সেটি ইংরেজি। আর বাংলা মাধ্যমে যারা লেখাপড়া করে তাদের ভেতরও ইংরেজির প্রতি আগ্রহ যে কমছে না বরং বাড়ছে, এতেও নিশ্চয় সন্দেহ নেই। উচ্চস্তরে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না দেয়ার ব্যর্থতার দরুন শিক্ষা গভীর হচ্ছে না, এমনকি তাকে যথার্থ শিক্ষাও বলা যাচ্ছে না, কেননা মাতৃভাষা ছাড়া কোনো শিক্ষাই যথার্থ হয় না। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার কার্যকর ব্যবহার নেই, অথচ সেখানে বাদী-বিবাদী, আইনজীবী, বিচারক সবাই বাঙালি। এটিও বাংলার অপ্রচলনের একটি করুণ দৃষ্টান্ত বৈকি।

কিন্তু এসবের কারণ কী?

কারণটা স্পষ্ট, সেটা হলো দেশের শাসক শ্রেণি বাংলা ব্যবহারে আগ্রহী নয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এদেশের শাসকশ্রেণি বাংলা ভাষার ব্যাপারে কখনোই উৎসাহী ছিল না। অতীতে আমরা পরাধীন ছিলাম, বিদেশিরা আমাদের শাসন করেছে, তারা বাংলা ভাষা ব্যবহার করবে না, বরং তাদের নিজেদের ভাষা চাপিয়ে দিতে চাইবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। এ জন্য আমরা দেখেছি সংস্কৃত, ফার্সি এবং পরে ইংরেজি হয়েছে সরকারি ভাষা, বাংলা ভাষা সে মর্যাদা পায়নি। পাকিস্তানিরা চেয়েছিল উর্দুকে চাপিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত পারেনি। কিন্তু এখন তো দেশ শাসন করছে স্বদেশিরা, তাহলে এখনো কেন বাংলা সর্বত্র প্রচলিত হচ্ছে না? না হওয়ার ঘটনা এই মর্মান্তিক সত্যের প্রতিই ইঙ্গিত করে, আমাদের শাসকশ্রেণি এদেশেরই যদিও, তবু তারা ঠিক দেশি নয়। তারা জনগণের সঙ্গে নেই। নিজেদের তারা জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে, কিন্তু তাদের ভেতর দেশপ্রেমের নিদারুণ অভাব। এককথায় এদেশে তাদের অবস্থানও আগের বিদেশিদের মতোই; তারা কেবল যে জনবিচ্ছিন্ন তা নয়, জনবিচ্ছিন্নতার দরুন তাদের ভেতর গোপন অহংকার রয়েছে। অপরদিকে তাদের সংযোগ যে পুঁজিবাদী বিশ্বের সঙ্গে তার ভাষা স্পষ্টরূপে ইংরেজি। বাংলা জনগণের ভাষা, চিরকালই তাই ছিল, এখনো সেরকমই আছে; কিন্তু শাসকরা জনগণের থেকে দূরেই রয়ে গেছে, যেমন তারা আগে ছিল। শাসকশ্রেণির সন্তানেরা ইংরেজি শেখে, তারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে, বিদেশে ঘরবাড়ি কেনে এবং তাদের সন্তানরা বিদেশমুখো হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতেও বিদেশিদের হস্তক্ষেপ ঘটছে। শাসকশ্রেণি তাতে বাধা দেবে কি, তাদের তোয়াজ করে চলে।

বাংলার প্রচলনের অন্তরায় অন্য কেউ ঘটাচ্ছে না, জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে দেশের বিদেশমুখো ও বিদেশপ্রভাবিত শাসকরাই ঘটাচ্ছে। শাসকশ্রেণির ভেতর রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, আমলা, পেশাজীবী সবাই আছে। তাদের প্রধান যোগ্যতা তারা ধনী। এরা ইংরেজি ব্যবহার করতে পারলে খুশি হয় এবং যখন বাংলা ব্যবহার করে তখন মনমরা থাকে এবং ভাষাকে বিকৃত করে। রাজনীতিকরাই প্রধান, তারাই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান, তাদের বক্তব্যই আমরা শুনি; লোকে তাদেরই দৃষ্টান্ত বলে মানে, প্রভাবিত হয়, অনুকরণ করে। জাতীয় সংসদে, সভা সমিতিতে রাজনীতিকরা যে ভাষা ব্যবহার করে তাতে অনেক সময় কানে আঙুল দিতে ইচ্ছা করে। যারা রাজনীতিক নয় তারাও বাংলা ব্যবহার করে বেশ স্বাধীন ভাবে; উচ্চারণ ও ব্যাকরণের তোয়াক্কা করে না, আঞ্চলিকতার সঙ্গে ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে জগাখিচুড়ি তৈরি করে। যেসব ভুল ইংরেজির ব্যবহার ঘটালে তারা লজ্জায় ম্রিয়মাণ হতো সেগুলো নির্বিচারে ঘটাতে থাকে। লজ্জা পাবে কী, অনেক সময় তারা গর্ব অনুভব করে, ভাবে বাংলা ভালোভাবে না জানাটাই তাদের আভিজাত্যের প্রমাণ। দেশের পরিস্থিতিতে যে নৈরাজ্য বিরাজমান তার ছবি ভাষার প্রতি এই দুর্ব্যবহারের মধ্যে চমৎকারভাবে ফুটে ওঠে। ওদিকে জনসাধারণের বড় একটা অংশ অশিক্ষিত; যাদের শিক্ষিত বলে গণ্য করা হয় তাদেরও অনেকেই অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মাত্র, যথার্থ অর্থে শিক্ষিত নয়। এদের পক্ষে বাংলা ভাষার যথার্থ ব্যবহার সম্ভব নয়।

জনসাধারণের আশা পূরণের ক্ষেত্রে পাকিস্তান যে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হবে তার প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়েছিল ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। অবশ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেও দেশের সব বুদ্ধিজীবীই যে মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেছিলেন তা নয়। ঢাকাতেই ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে একটি ক্ষুদ্র অথচ তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল অধ্যাপক ও ছাত্রদের নিয়ে। এরা সংস্কারমুক্তি ও স্বাধীন চিন্তার ওপর গুরুত্ব দিতেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও এদের মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। নজরুল ইসলামকে নিয়ে পাকিস্তানবাদীরা পরবর্তীকালে অনেক বাগাড়ম্বর করেছে, কিন্তু নজরুল ইসলাম কোনোদিনই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে আস্থাশীল ছিলেন না, তিনি বরং আস্থা রেখেছিলেন শ্রমিক কৃষকদের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে।

এটা আগের কথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে, এমনকি যারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্যে মঙ্গলের প্রত্যাশা দেখেছিলেন তারাও কিছুটা চিন্তিত না হয়ে পারেননি। চিন্তিত হয়েছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে চালু করার উদ্যোগ-প্রয়োজন দেখে। ১৯৪৮-এর গোড়ার দিকেই অধ্যাপক ও ছাত্রদের একাংশ দাবি তুললেন অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে। সরকারের দিক থেকে বিরোধিতা এলো, প্রত্যাশিত বিরোধিতা। এবং তখনি সেই সময়ই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের জায়গায় নতুন এক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটল, বাঙালি জাতীয়তাবাদের। ঘটনাটা তেমন কোনো ঘটা না করেই ঘটল। অধিকাংশ মানুষই লক্ষ করল না রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য যে কি, এ যে কোন পর্যন্ত যাবে সেটা শাসকরা তখন বোঝেনি, এমনকি তারাও বোঝেননি যারা শুরু করেন এই আন্দোলন।

পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের যখন জন্ম হয় তখন সেই জন্মের পেছনে একটি অতিপ্রধান ভূমিকা ছিল ভয়ের। মুসলিম মধ্যবিত্ত ভয় পেয়েছিল অবিভক্ত ভারতে তাদের ভবিষ্যৎ নেই মনে করে। সেই ভয় তারা সংক্রমিত করে দিয়েছিল জনসাধারণের মধ্যে। প্রধানত ভয়ের কারণেই, ইংরেজের ভয়, তারচেয়ে বড় ভয় হিন্দুর ভয়ের তাড়নাতেই মুসলমানদের প্রায় সব ভোটই গিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের বাক্সে। এখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই এলো এই নতুন ভয়, উর্দুর অর্থাৎ উর্দু ভাষাভাষীদের। আশঙ্কা হলো উর্দু চাপিয়ে দেয়ার ফলে বাঙালিরা চিরকালের জন্য বোবা হয়ে যাবে, তারা গোলাম হয়ে যাবে পাঞ্জাবিদের। বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো সেই ভয় জাগিয়ে দিল মানুষকে, প্রথমে বুদ্ধিজীবী সমাজের একটি অংশকে, পরে ছাত্রদের এবং তারও পরে সমগ্র দেশবাসীকে। বড় ভয় এসে ছোট ভয়কে, নিরাপত্তার ভয়কে, ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারার ভয়কে জয় করে নিল। ভীতসন্ত্রস্ত বাঙালি দেখল তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। তখন মরিয়া হয়ে ওঠা ভিন্ন অন্য কোনো পথ রইল না। যে শাসকরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল, সেই শাসকরাই আজ নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলাদেশের সব মানুষের স্বার্থ যে এক ও অভিন্ন সেই জ্ঞানটা বাংলাদেশের মানুষের কাছে এনে দিল। শাসকদের স্ববিরোধিতার পুরাতন নাটক এখানেও নতুন করে অভিনীত হলো, স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়েই তারা স্বার্থ বিনষ্ট করল।

লেকক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035989284515381