করোনা প্রকোপ সারাদেশে ব্যাপকভাবে বাড়তে শুরু করেছে। দিন দিন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। করোনা পরিস্থিতিতে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ৯২ হাজার কোটি টাকার বিশাল প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।
সরকারি, বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) ও স্বায়ত্বশাসিত সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের আপাতত বড় ধরনের সমস্যা না থাকলেও কঠিন বিপদের মধ্যে পড়েছেন হাজার হাজার নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী। দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই ধরনের নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন।
প্রথমত আছেন নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ ও মাদরাসা)। যাদের জন্য জনবল কাঠামো তৈরি করা আছে, কিন্তু সরকারি কিছু নিয়ম নীতির কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানই এমপিও না হওয়ায় সেই সকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হতে পারেননি। দীর্ঘ দিন পর সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত বছর নতুন করে এমপিওভুক্তির জন্য দুই হাজার ৭৪৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করে। সেই তালিকায় অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠান বাদ পরে আর অযোগ্য প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার খবর শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষায় প্রকাশ হয়। পরে অন্যান্য মাধ্যমেও প্রকাশ হয়। মাননীয় সংসদ সদস্যরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সারাদেশ বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় আরও বেশি সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জনবল কাঠামো সংশোধন করার জন্য একটি কমিটি গঠন করে। সংশোধনী কমিটির মিটিংও প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সারা দেশের শিক্ষকরা আশা করে স্বাধীনতার পরে বেসরকারি এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে কর্মরত অনার্স মাস্টার্স শিক্ষকদের সাথে যোগ্যতা সম্পন্ন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হোক।
দ্বিতীয়ত, আছেন জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রায় ৩৫০টি এমপিওভুক্ত ডিগ্রি কলেজে নন-এমপিও অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের মাত্র ৫ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। যাদের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় দীর্ঘ ২৮ বছরেও জনবল কাঠামো তৈরি না করায় শুধুমাত্র অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষক-কর্মচারী এমপিও সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে এই সকল শিক্ষক কর্মচারী সরকার থেকে এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পান না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিষয় খোলা ও নিয়োগ বোর্ডে প্রতিনিধি মনোনয়ন দিয়ে দায় শেষ। তাদের ফান্ডে শত শত কোটি অলস টাকা পড়ে রয়েছে। সেই টাকা সরকারি কোষাগারে জমা নেয়ার সিদ্ধান্ত হলেও অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের কপালে কিছুই জোটে না। শিক্ষকদের বিশেষ অনুরোধে মাঝে মধ্যে এমপিওভুক্তির জন্য একটু সুপারিশ করে থাকেন। যা শুধু পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়। মন্ত্রণালয় ওইসব সুপারিশ আমলে নেন বলে কোনো তথ্যপ্রমাণ অদ্যাবধি পাই না।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এই শিক্ষকরা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকাকালীন শিক্ষকরা সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর জন্য কেউ কেউ প্রাইভেট টিউশনি ও ব্যবসা বাণিজ্য করে কোনোরকম সংসার চালাতেন। যেটাকে বলা যায় দিন আনা দিন খাওয়ার অবস্থা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর চালাতে পারছেন না। কারো কাছে সাহায্যও চাইতে পারছেন না। তারপর আবার রমজান মাস। বর্তমানে পরিস্থিতি খুবই খারাপ। কারো কাছে সাহায্য চাওয়া তো দূরের কথা, সাহায্যের কথা মনে আসতেই লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। কারণ আমরা তো শিক্ষক, আত্মসম্মান বোধ টুকু ছাড়া আমাদের তো আর কিছুই নেই। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনা তহবিল থেকে আমাদের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন।
বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের জন্য সরকার ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ অনুমোদন দিয়ে অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের পাঠদানের অনুমতি দেয়। এমতাবস্থায় কলেজ কর্তৃপক্ষ একান্তই মানবিক দিক বিবেচনা করে শিক্ষক-কর্মচারীদের কলেজে যাতায়াত খরচ ও পোশাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা বাবদ মাসিক নাম মাত্র কিছু টাকা সম্মানী হিসেবে দিয়ে থাকে। যা দিয়ে মাসের এক সপ্তাহের ন্যূনতম বাজার খরচ চলে না। সেই সম্মানীটাও অনেক কলেজ প্রায় ১০ থেকে ১২ মাস বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বর্তমানে লকডাউনের কারণে ঘরে বসে শিক্ষকদের অর্ধাহারে অনাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে এই মুহূর্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সহযোগিতা করা প্রয়োজন। দেশের এই চরম ক্রান্তিলগ্নে সরকারকে সহযোগিতা করার পাশাপশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত নন-এমপিও অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষকদের প্রতি মাসে বেতন ভাতা প্রদান করা প্রয়োজন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে থেকে লাভ কি? যদি সেই টাকা সরকারের বা জনকল্যাণে কাজে না লাগে। সেখান থেকে এই শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেয়া হলে মাসে মাত্র ১১ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হবে। ছাত্র বেতন কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমার ব্যবস্থা করা হলে মাসে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ কোটি টাকার বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা হবে। যা থেকে বছরে উদ্বৃত্তের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৬৮ থেকে ২১৬ কোটি টাকার বেশি। শুধুমাত্র সঠিক নীতিমালা না থাকার কারণে এবং উপাচার্য মহোদয়ের স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিক প্রীতি এবং বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে এই টাকা সরকার অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা হয় না। যার ফলে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্র/ছাত্রী সবাই বঞ্চিত হচ্ছে।
শিক্ষকদের এমপিওর জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে। সরকার বিব্রতবোধ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগতমানও অতিতের ঐতিহ্য হারিয়ে একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। এই টাকা সরকারি রাজস্ব খাতে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাগারে জমা করা হলে সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঞ্চিত শিক্ষক সমাজ, ছাত্র/ছাত্রী সবাই উপকৃত হবে। এর ফলে আমাদের আর এমপিওর জন্য রাস্তায় নামতে হবে না। সরকারকে বিব্রত অবস্থায়ও পড়তে হবে না। শিক্ষার গুণগতমান ও তলানী থেকে ফিরে এসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার গুণগত মানের সাথে প্রতিযোগিতা করবে। এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্রুত পলিসি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে প্রয়োজনে দীর্ঘদিন যাবত আন্দোলনরত শিক্ষক নেতাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের বৈঠক করে সঠিক করণীয় নির্ধারণপূর্বক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা চাইতে হবে।
যে শিক্ষকরা বেতন পায় না তাদেরকে দিয়ে শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের দেয়া এক হাজার কোটি টাকা ট্রেনিং বাবদ ব্যয় করা হলে শিক্ষার গুণগত মান কি প্রকৃতপক্ষে বৃদ্ধি পাবে? পাবে না। বরং এই টাকা এক প্রকার অপচয় হবে। সারা দেশের বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন এবং তাদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচণের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের প্রতি শিক্ষকরা চরম ক্ষুব্ধ। ইতোমধ্যে অনেক শিক্ষক তাঁর পদত্যাগও দাবি করেছেন। ২৮ বছর বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষকদের বেতন দিতে পারে না। শুধু নতুন নতুন কলেজে নতুন বিষয় অনুমোদন দিয়েই খালাস। এটা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের চরম ব্যর্থতাই নয়। সরকারের ভাবমূর্তিরও বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকারকে বিব্রত করার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয় এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কি না তা অনেকেই জানতে চান। কারণ দেশে দীর্ঘদিন সরকার প্রধান হিসেবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি তো বঙ্গবন্ধুর কন্যা। তার উদারতা, মহনুভবতা, সততা, সাহস, বিচক্ষণতা আমরা সবাই জানি। তিনি দেশের প্রতিটি মানুষের অভাব ও দুঃখ-দুর্দশা মোচনের জন্য দিনরাত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। সেই প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে হাতে গোনা মাত্র কয়েক হাজার শিক্ষকের এমপিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনতে পারছেন না। এটা কি সহজে বিশ্বাসযোগ্য? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যকে সবিনয় প্রশ্ন করি, এই ব্যর্থতার দায় ভার আসলে কার?
সম্প্রতি সরকার করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘমেয়াদী অনেক সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের সাধারণ ক্ষমা করে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ পেয়েছে। কোভিড-১৯ এ লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। সেই হিসেবে বাঁচব কি না জানি না।
তবে মুজিব শতবর্ষে সরকারের সাহসী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পূর্বে অন্তত যেন শুনে যেতে পারি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদেরকেও কয়েদীদের মতো সাধারণ ক্ষমা করে এমপিওভুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। নন এমপিওর অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন।
লেখক : নেকবর হোসাইন, আহ্বায়ক, বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফোরাম, কেন্দ্রীয় কমিটি।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন]