আর কত সিকি বোনাসের ঈদ? - দৈনিকশিক্ষা

আর কত সিকি বোনাসের ঈদ?

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

স্কুল-কলেজের কোনো কোনো শিক্ষক বন্ধু সামনে পেলে জানতে চান, 'বৈশাখী ভাতার কী হলো? ইনক্রিমেন্ট কি আদৌ পাওয়া যাবে?  আর কতো ভগ্নাংশের বোনাস নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে হবে? জাতীয়করণের খবর কী?’ কিন্তু কাউকে এসবের সন্তোষজনক জবাব দিতে পারি না। সঠিক উত্তরও জানা থাকে না।

কার জানা আছে সে কথাটিও বলতে পারি না। সে সব সরকারের পলিসির বিষয়। সরকারের লোকেরাই ভালো বলতে পারে। বৈশাখী ভাতা, ইনক্রিমেন্ট, টাইমস্কেল ও সর্বোপরি জাতীয়করণ নিয়ে এক আধটু লেখালেখি করি বলে  অনেকেই এসব বিষয়ে ফোনে এবং ই-মেইলেও প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে থাকেন। তাতে মোটেও বিরক্তি বোধ করি না। কেননা এসব তো কমন প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করারই কথা। লেখালেখি না করলে অন্য যারা লেখেন, আমি নিজেও তাদের এসব প্রশ্নই করতাম। কোনো কোনো শিক্ষক বন্ধু তো একেবারে খেদ ধরে বলে বসেন, 'কী মিয়া, এত্তোসব লেখালেখি করেন। ইনক্রিমেন্ট কিংবা বোনাস তো এক পয়সাও পাইয়ে দিতে পারলেন না। বাদ দেন এসব লেখালেখি।

নিজেরও কখনো সখনো মনে হয় এ নিয়ে আর লেখালেখি করে লাভ নেই। কিন্তু পরক্ষণে ভাবি, কাউকে না কাউকে তো এ সব বিষয়ে লিখে যেতে হবে। লিখতে হবে। নিজের তো আর লড়াই সংগ্রাম কিংবা আন্দোলন করার গায়ে জোর কিংবা মুরোদ কোনটিই নেই। ঘরে বসে লেখালেখি করে একটু লাফালাফি করা এই আর কী! তাই আমৃত্যু লিখে যাবার একটা দৃঢ় প্রত্যয় নিজের অজান্তেই মনের মাঝে জন্মে যায়। শিক্ষক-কর্মচারীর এ কোনো নতুন কিংবা অহেতুক দাবি নয়। এ তাদের বহুদিনের অধিকার। কেবল অধিকার বললে ভুল হয়। ন্যায্য অধিকারই বলা সঙ্গত। সে পাওনাটা পাইয়ে দিতে কাউকে না কাউকে তো সোচ্চার হতে হবে। শিক্ষক-কর্মচারীর এসব ন্যায্য অধিকার মাটি চাপা দেয়া যায় না। তাদের সমিতিগুলোর সবার অভিন্ন দাবি। কিন্তু আদায়ের ঐক্যবদ্ধ কোন প্রয়াস আছে বলে মনে হয় না। তারা সব সময় বলেন, 'দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। এ ও বলেন, একতাই বল। 

কিন্তু নিজেদের মাঝে যেমন একতার অভাব তেমনি দশে মিলে কাজ করার মানসিকতা ও তেমন একটা আছে বলে মনে হয় না। সকলে নেতা। কিন্তু দাবিগুলো আদায় করে ছাড়ার মত নেতা নেই। বেশির ভাগ জায়গায় 'গাঁয়ে মানে না নিজে মোড়ল। তা না হলে শিক্ষকদের দাবি দাওয়া কেউ আমলে নেয় না কেন? এই কমন ইস্যুগুলোতেও যদি সব ক'টি শিক্ষক সমিতি এক না হতে পারে, তবে তাদের মধ্যে জীবনে আর কোনদিন ঐক্য হবে?

   এই তো সেদিন স্কুল-কলেজের ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা কী চমৎকার একটা আন্দোলন করে কেমন করে এর ফসল ঘরে তুলতে হয়, তা গোটা দেশের মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছে। শিখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাদের স্যারেরা নিজেদের একান্ত ন্যায্য দাবি-দাওয়া এতদিন থেকে আদায় করতে পারেন না । ছাত্রদের এ আন্দোলন থেকে সকলের  শিক্ষা নেবার অনেক কিছু আছে।   আরেকটা জুলাই মাস বলা যায় নীরবে কেটে গেলো। দেশের সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আশা করেছিলেন অন্তত এবার তারা ইনক্রিমেন্ট থেকে বঞ্চিত হবেন না। বৈশাখী ভাতা নিয়েও গত বৈশাখে এমন একটা আশা সবার মনে জেগে উঠেছিল। একটি পুরো ঈদ বোনাস সঙ্গতভাবে সকলেই কামনা করেছিলেন। কিন্তু সব আশায় গুঁড়ে বালি। সবগুলো দাবি এক জায়গায় জড়ো করে কে যেন দাবিগুলোর গলা টিপে ধরে রেখেছে? দাবিগুলো কবরে পুঁতে দিয়েছে। চারদিকে নীরবতা। সকলেই নিশ্চুপ। 

কেউ কেউ বলেন, দেশ গরিব। এত শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার কী করে ইনক্রিমেন্ট, বৈশাখী ভাতা ও শত ভাগ বোনাস দেবে? ভাল কথা। চমৎকার অজুহাত। শেয়ার বাজার কেলেংকারী, ডেসটিনি কেলেংকারি, ব্যাংক কেলেংকারি, হলমার্ক কেলেংকারি ইত্যাদি সব কেলেংকারিতে কি দেশের অযুত-লক্ষ-নিযুত কোটি টাকা অপচয় হয়নি? বাসচাপায় শিক্ষার্থী নিহত হলে মন্ত্রী মহোদয় হাসেন। আবার কয়েকশ' কোটি টাকা দুর্নীতি হলে আরেক মন্ত্রী মহোদয় বলেন, এ তেমন কিছু না। 

এই সেদিন কয়েক হাজার টন কয়লা উধাও হলো। গত ক'দিন আগে আবার কয়েক হাজার টন পাথর গায়েব। কত হাজার কোটি টাকা চোরদের পকেটে গেছে সে মনে হয় আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।   আজকাল অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগ। মিডিয়ার সুবাদে দুনিয়ার কোথায় কখন কী ঘটে, তা অতি সহজেই ঘরে বসে জানা যায়। তাই সিঁদেল চুরি থেকে পুকুর চুরি পর্যন্ত কোনো চুরির ঘটনা কারো অজানা থাকে না। সেই আদিকাল থেকে সম্পদে ভরপুর প্রিয় মাতৃভুমি সোনার বাংলাদেশ। কতো চুরি হয়। তবু এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। কোথাও আটকাচ্ছে না। কেবল শিক্ষা ও শিক্ষকের জন্যে কিছু দেবার সময় যতসব অভাব অনটন। 

 বছরে দশ-বারটা কিংবা কুড়ি-পঁচিশটা ঈদ নয়। দু'টো মাত্র ঈদ। এ দু' ঈদের কষ্টটা বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর সারা জীবনের কষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। কী যে মনের কষ্টে তারা ঈদগুলো উদযাপন করেন সে কেবল তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। আনন্দের পরিবর্তে ঈদ তাদের জন্যে প্রতি বছর কষ্টের বার্তা নিয়ে আসে। সিকি আনা ঈদ বোনাস তাদের জন্যে যথেষ্ট তো নয় বটে, উল্টো তাদের মনের কষ্টটাই বাড়িয়ে তোলে।  

এবারের ঈদুল আজহা আমাদের খুব কাছে এখন। আর মাত্র দশ-বারদিন বাকি। সিকি আনা বোনাস! সেটিরও আজ অবধি খবর নেই। বহু জায়গায় শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ পর্যন্ত জুলাই মাসের বেতনটুকুও পাননি। সব মুসলমানের ঈদুল আজহায় কোরবানি দেবার একান্ত ইচ্ছে জাগে। গাঁও-গেরামের প্রায় মানুষ কোরবানির বন্দোবস্ত করে ফেলেছেন। কেবল বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর অনেকেই এখনো কোরবানি দেবেন কিনা ঠিক করতে পারেননি। সিকি আনা বোনাসের টাকায় একটি গরু নয় একটি খাসি ও কোরবানি করা অনেক কঠিন। ভাগ্যিস, ইসলাম ধর্মে অংশী হয়ে কোরবানি দেবার বিধান না থাকলে বেসরকারি অনেক শিক্ষক-কর্মচারী জীবনেও কোরবানি দিতে পারতেন কীনা কে জানে? শিক্ষকের মর্যাদা ধুলোয় মিশিয়ে দেবার জন্যে সিকি আনা বোনাসের ধারণাই যথেষ্ট।

এ তো একজন শিক্ষকের জন্য কষ্ট ও অপমান দু'টোই বটে। এ লজ্জা থেকে তাদের মুক্তি দেয়া একান্ত অপরিহার্য। লজ্জায় সিকি ভাগ বোনাসের কথা নিজের স্ত্রী-সন্তানকেও বলা যায় না। অন্যকে তো বলার প্রশ্নই ওঠে না। এ কষ্টটা একান্ত একা একা শিক্ষক-কর্মচারীকে বয়ে বেড়াতে হয়। অনেককে এ কষ্টটা ধুঁকে ধুঁকে মেরে নিঃশেষ করে দেয়। বহু শিক্ষক-কর্মচারী জানতে চান, জীবনে আর কত ভগ্নাংশের ঈদ তাদের পার করতে হবে? এ বড় কষ্টের। এ বড় লজ্জার বিষয়।   কোন এক শিক্ষাবোর্ডের জনৈক কর্মকর্তা আমার বেশ পরিচিত। তিনি বলেছেন, তারা নাকি বছরে পাঁচ-সাতটা বোনাস পেয়ে থাকেন। বিভিন্ন শ্রেণির রেজিস্ট্রেশনের সময়, পাবলিক পরীক্ষার ফরম পুরণের সময় ও ফল বেরুনোর সময়। দু' ঈদে দুই বোনাস তো আছেই ।

সবগুলো বোনাস নিজ নিজ স্কেলের শত ভাগ। সে হিসেবে শিক্ষক-কর্মচারীদের স্কুল-কলেজে ভর্তির সময়, সবগুলো অভ্যন্তরীণ ও পাবলিক পরীক্ষার সময়, ফল দেবার সময় বোনাস পাওয়া উচিত। দু'টো ঈদে তো তাদের পুরো বোনাস দেন দরবার ছাড়াই দিয়ে দেয়া সমীচীন। তা না হলে জাতি হিসেবে দিনে দিনে আমাদের মান-মর্যাদা কেবলি হ্রাস পেতে থাকবে। যে জাতি তার শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দিতে জানে না, সে জাতি অমর্যাদা নিয়েই বেঁচে থাকে। এমন করে বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না। 

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট,  সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।

চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006105899810791