'বিচিত্র প্রবন্ধ' বইয়ের অন্তর্ভুক্ত 'লাইব্রেরি' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানব হৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!'
লাইব্রেরি তথা বই সম্পর্কে এমন তাৎপর্যপূর্ণ কথা বাংলা ভাষায় কি আর আছে? বই পাঠের মধ্য দিয়ে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ৪০ বছর আগে যাত্রা শুরু করেছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। 'আলোকিত মানুষ' কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র প্রকাশিত প্রথম পরিচিতি পত্রিকায় আলোকিত মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে '...যারা সংস্কৃতিবান, রুচিশীল, সত্যান্বেষী, যারা জ্ঞানার্থী, সক্রিয়, সৃজনশীল; বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তাঁদের পদপাতে, মানস বাণিজ্যে, বক্তৃতায়, বন্ধুতায়, উষ্ণতায় সচকিত একটি অঙ্গন।' বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তোলার প্রয়োজন কেন হলো? স্বপ্নদ্রষ্টা প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও আমি' বইয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন- 'আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ আর আলোকিত, চিন্তাশীল, উদার এবং দার্শনিক দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষদের জন্ম দিচ্ছে না। আমাদের অধিকাংশ অভিভাবকই ছেলেমেয়েদের বাইরের বই পড়তে দিতে নারাজ। তাদের ধারণা, এতে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়। সন্তানদের উজ্জ্বল পেশাগত ভবিষ্যতের যে ছবি তারা চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন, এসব অপাঠ্য বইপত্র পড়াশানার ফলে সেই ভবিষ্যৎ ধ্বংসের আশঙ্কায় তারা ছেলেমেয়েদের তার ধারেপাশে ভিড়তে দিতে নারাজ।'
এই বেদনাদায়ক চিত্র বর্তমান সময়ে অধিকতর প্রাসঙ্গিক। বৈষয়িক সিদ্ধি অর্জনই এখন লেখাপড়ার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক পাগলের মতো ধাবমান জিপিএ ৫ নামক সোনার হরিণের পেছনে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নৈতিকতাবর্জিত পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করছেন না। যে কোনো প্রকারে পরীক্ষায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের এই স্থূল প্রতিযোগিতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ঝরে যাচ্ছে অগণিত শিক্ষার্থীর স্বপ্ন। সম্প্রতি রাজধানীর একটি স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী অরিত্রির আত্মহত্যা বিবেকবান মানুষকে ভীষণ নাড়া দিয়েছে। ঘরে-বাইরে এমন অরিত্রির সংখ্যা নগণ্য নয়। তাদের সবার খবর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। ভোগবাদী বিশ্বায়নের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা আজ বাণিজ্যিকীকরণের শিকার।
নৈতিকতা, মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে বৈষয়িক বুদ্ধিকেন্দ্রিক স্বার্থপর প্রজন্ম গড়ে তুলতেই অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৎপর। পরিণতিতে যন্ত্রের মতো বড় হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকদের গগনচুম্বী প্রত্যাশার চাপ, শিক্ষকদের যত্নের অভাব শিক্ষার্থীদের ভেতরে যথার্থ মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটতে দিচ্ছে না। এই গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে সংশপ্তক ব্রত পালন করে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে উচ্চায়ত মূল্যবোধসম্পন্ন, আলোকিত, উদার ও শক্তিমান মানুষের নেতৃত্ব জাতিকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের নেতৃত্ব তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে এ প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বইগুলো পড়ানোর কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় সাংস্কৃতিক কর্মসূচি।
এভাবে বই পড়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে হৃদয়বৃত্তির বিকাশ ঘটেছে। জেলা ছাড়িয়ে পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ২৫০টি উপজেলায়। প্রতি বছর এ কার্যক্রমের সদস্য সংখ্যা ২২ লাখ। প্রতি বছর বর্ণিল ও উৎসবমুখর পরিবেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী মূল্যবান বই পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করে। এটি এক অপূর্ব দৃশ্য। বই পড়ার সুবিধাকে সারাদেশে সহজলভ্য করার লক্ষ্যে প্রতিটি জেলায় ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ সম্পূূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশের সব জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন ও বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলোতে বই পড়ার সুবিধা পৌঁছে যাবে। শুধু ধ্রুপদী বই নয়, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের রস আস্বাদনের জন্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা তৈরি হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে।
নবনির্মিত সাংস্কৃতিক ভবনে একটি আর্ট গ্যালারিসহ শিল্প-সংস্কৃতির জগতের আনন্দযজ্ঞের হাতছানি রয়েছে। বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের চিরায়ত বইয়ের প্রকাশক হিসেবে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মর্যাদা অর্জন করেছে। বাঙালি মনীষীরা বিভিন্ন বিষয়ে গত ২০০ বছরে যা লিখেছেন, তা থেকে ১৬টি বিষয়ে শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো নির্বাচন করে ২০০ খণ্ডে প্রকাশের অনন্যসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অন্যতম কর্মযজ্ঞ 'আলোর ইশকুল'। এই কর্মসূচির অন্তর্গত ১৫টি চক্রের শিরোনাম যে কোনো সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করবে। গ্রিক সভ্যতা, উপমহাদেশীয় ধ্রুপদী নৃত্য, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ফটোগ্রাফি কোর্স, বিশ্বসাহিত্য পাঠচক্র, চলচ্চিত্র চক্র, আবৃত্তি চক্র, গাছ, ফুল ও নিসর্গ পরিচিতি, চিত্রপ্রদর্শনী, নাট্যানুষ্ঠান, বিষয়ভিত্তিক বক্তৃতা ও মুক্ত আলোচনার ঈর্ষণীয় সম্ভার আবালবৃদ্ধবনিতার জীবনকে দীপান্বিত করতে সক্ষম।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের দীপ্তি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষক, সাহিত্যিক, সম্পাদক, উপস্থাপক, বাগ্মী-কর্মযোগী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বহুমাত্রিক ব্যক্তিত্বের সম্মিলন ঘটেছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। যে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, সে দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি গড়ে তুলেছেন এই প্রতিষ্ঠানটি। লক্ষ্য সম্পর্কে তিনি লিখেছিলেন- "আজ অনেক আলোকিত মানুষ চাই; আমাদের চাই অনেক সম্পন্ন মানুষ, না হলে এ মুখহীন কালো অবক্ষয়ের হাত এড়িয়ে এই জাতিকে শক্তি ও সম্ভাবনার দরজায় উত্তীর্ণ করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হবে। ওই মানুষদের আজ চাই আমাদের বিপুল সংখ্যায়, এককে, দশকে নয় সহস্রে, লক্ষে। আর শুধু সংখ্যায় হলেই চলবে না, তাদের হতে হবে সমবেত, একত্রিত, আয়োজিত। তাদের গ্রথিত করতে হবে শক্তিশালী সংঘবদ্ধতায়। এই সংঘবদ্ধতার ভেতর দিয়েই শুধু তাদের উত্থান ঘটতে পারে 'জাতীয় শক্তি' হিসেবে। ... সারাদেশে 'অর্থপূর্ণ' ও 'সম্পন্ন' মানুষ গড়ে তোলা এবং সংঘবদ্ধ শক্তি হিসেবে তাদের একত্রিত করাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মূল লক্ষ্য।"
কোনো সন্দেহ নেই; চার দশক আগের সমাজ ব্যবস্থায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই লক্ষ্য ছিল স্রোতের বিপরীতে অবস্থান নেওয়ার শামিল। গড্ডলিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে, গতানুগতিক ধ্যান-ধারণার বিপরীতে অধিষ্ঠিত হয়ে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পক্ষে দীপ্তিমান ও সমবেত শক্তির উদ্বোধন ঘটিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। বন্ধুর পথে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের এই অগ্রযাত্রা জয়যুক্ত হোক।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কলেজ কর্মসূচির প্রাক্তন সদস্য ও পাঠচক্র সমন্বয়কারী
সূত্র: সমকাল