গত ১৭ জুলাই সারা দেশে এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষিত হয়েছে। দেখা গেছে, বিগত বছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার ও জিপিএ ৫-এর আকার বড় হয়েছে। ১০ বোর্ডে ২০১৭ সালে পাসের গড় হার ছিল ৬৮.৯১ শতাংশ, ২০১৮ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬৬.৬৪ শতাংশে এবং ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩.৯৩ শতাংশে। যদি কারিগরি ও মাদ্রাসাকে পৃথক করি তাহলে কেবল এইচএসসিতে পাসের হার ৭১.৮৫ শতাংশ। তবে দেখার বিষয় হল- ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো ফল করেছেন।
ছেলেরা যেখানে গড়পড়তা পাস করেছেন ৭১.৬৭ শতাংশ, সেখানে মেয়েদের পরিসংখ্যান ৭৬.৪৪ শতাংশ। ছেলে পরীক্ষার্থী ছিলেন ৭ লাখ ৩ হাজার। তাদের মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ৩ হাজার ৮২৮ জন। অপরদিকে মেয়ে শিক্ষার্থী অংশ নেন ৬ লাখ ৩৩ হাজার ৬২৯ জন। পাস করেছেন ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৪৪ জন। তবে জিপিএ-৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় এগিয়ে। রোববার (২৮ জুলাই) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন মুঈদ রহমান।
এ বছরের যদি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষাকে আমলে নিই, তাহলে দেখব সেখানেও মেয়েদের আধিপত্য। সে পরীক্ষায় মেয়েরা পাস করেছেন ৮৩.২৮ শতাংশ, যেখানে ছেলেদের অবস্থান ৮১.১৩ শতাংশ। মোট ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন জিপিএ-৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৫৩ হাজার ৫৯৪ জনই মেয়ে। আর ছেলের সংখ্যা ৫২ হাজার ১১০ জন।
এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের পরই শুরু হয় বিশেষায়িত ও উচ্চশিক্ষা। সেখানেও মেয়েদের আধিপত্য কম নয়। কিন্তু এ মাত্রা কর্মজীবনে বজায় থাকে না। এ নিয়ে কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান জাতীয় দৈনিকে একটি চমৎকার বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন। আমি তার সঙ্গে সহমত পোষণ করে কিছুটা সংযোজনের প্রয়াস নেব।
শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর বয়স হল ১৫ থেকে ২৪ বছর। সেখানেও মেয়েদের অবস্থান ছেলেদের তুলনায় ভালো। ইউএনডিপি’র প্রতিবেদন বলছে, এই বয়সীদের গড় শিক্ষার হার হচ্ছে ৭৫.৪ শতাংশ, যার মধ্যে মেয়েদের ৭৬.৬ শতাংশ এবং ছেলেদের ৭৪ শতাংশ। প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রেও দেখা যায় সেখানে মেয়েদের পরিসংখ্যান ৯৮.৮ শতাংশ আর ছেলেদের ৯৬.৬ শতাংশ।
সুতরাং শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে মেয়েদের যতটা দাপুটে অংশগ্রহণ, পেশাদার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার বেলায় তা অনেকখানিই কম। বিসিএস কর্মসংস্থান নিরূপণের একমাত্র মাপকাঠি না হলেও একটি বড় ধরনের পরিমাপক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সে হিসাবে আমরা বিগত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার ফলের দিকে নজর দিতে পারি। ৩২তম বিসিএসে (বিশেষ) মেয়েদের সাফল্য ছিল লক্ষ করার মতো। সেখানে ৫৫.১ শতাংশ বা ৯২৩ জন মেয়ে সফলতার মুখ দেখেন।
ছেলেদের বেলায় তা মাত্র ৪৪.৯ শতাংশ বা ৭৫২ জন। কিন্তু এর পর থেকেই ক্রমাগত হ্রাসমান। ৩৩তম বিসিএসে মেয়েদের সফলতা নেমে এসে দাঁড়ায় ৩৮.২৬ শতাংশে, ব্যক্তি হিসেবে ৩ হাজার ২৫৫ জনে। সেখানে সফল ছেলেদের কৃতিত্ব ৬১.৭৪ শতাংশ বা ৫ হাজার ২৫২ জন। ৩৪তম বিসিএসে মেয়েদের সফলতার পরিসংখ্যান হল ৩৫.৬২ শতাংশ বা ৭৭৫ জন। অপরদিকে ছেলেদেরটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৪.৩৮ শতাংশে বা ১ হাজার ৪০১ জনে।
৩৫তম বিসিএসে মেয়েদের অবস্থান আরও নিচে নেমে যায়। সেখানে সফল প্রার্থীদের ২৭.৯২ শতাংশ বা ৬০৯ জন মেয়ে এবং ৭২.০৮ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৭২ জন ছেলে। ৩৬তম বিসিএসে তা আরও কমে যায়। মেয়েদের সাফল্যের মাত্রা নেমে এসে দাঁড়ায় ২৬.২২ শতাংশে বা ৬০৯ জনে এবং ছেলেদের বেলায় তা ৭৩.৭৮ শতাংশ বা সংখ্যাগতভাবে ১ হাজার ৭১৪ জন।
আমরা যদি উদাহরণ হিসেবে ৩৬তম বিসিএসকে সামনে আনি, দেখব সেখানে ২ লাখ ১১ হাজর ২৮২ জনের মধ্যে ১ লাখ ৪১ হাজার ২৭০ জন পুরুষ (৬৬.৮৬ শতাংশ), ৭০ হাজার ৬ জন নারী (৩৩.১৩ শতাংশ) এবং ৬ জন (প্রায় ০.০০৩ শতাংশ) তৃতীয় লিঙ্গ। এদের মধ্যে প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় ৭৯.৭০ শতাংশ পুরুষ ও ২০.৩০ শতাংশ নারী উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় এসে পাস করে ৭৯.৮০ শতাংশ পুরুষ এবং ২০.২০ শতাংশ নারী।
মৌখিক পরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে ২৬.২২ শতাংশ নারী ও ৭৩.৭৮ শতাংশ পুরুষ নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সাল থেকে মেয়েরা বিসিএসে অংশ নিলেও ২৮টি ক্যাডারে তাদের অংশীদারি চোখে পড়ার মতো নয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/ডিভিশন, বিভাগ/ডাইরেক্টরি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে প্রথম শ্রেণির চাকরিজীবী পাওয়া যাবে ৭৩ হাজার ৬১৯ জন পুরুষের বিপরীতে মাত্র ৫ হাজার ৬৬ জন নারী।
বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে পুরুষের তুলনায় কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারেই বেড়েছে। বলা হয়ে থাকে, ১৯৭৪ সালে যা ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, সেটা ২০১৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৬ শতাংশে। মোট কর্মরত মানুষের ৩৭.৬ শতাংশ নারী গ্রামে আর ৩০.৮ শতাংশ নারী শহরে নিয়োজিত। আমাদের দেশের কর্মবাজারে নারীর সংখ্যা ১ কোটি ৮২ লাখ। তবে বাজারের বাইরে আছেন ৩ কোটি ৬১ লাখ। পাশাপাশি কর্মবাজারে পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ২৫ লাখ আর বাজারের বাইরে আছেন ৯৬ লাখ।
সে হিসাবে পুরুষের ৩ শতাংশ আর নারীর ৭ শতাংশ বেকার অবস্থায় আছেন। শহরের কথা বিবেচনায় নিলে তৈরি পোশাক খাত একটা বড় অংশজুড়ে আছে। গ্রামে আছে এনজিও ও নানা ধরনের সমিতি। কিন্তু এসব নারীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলার মতো কিছু নয়। আমাদের আলোচ্য বিষয়টিই ছিল উচ্চশিক্ষিত নারীরা শিক্ষার দিক থেকে যতটা এগিয়ে, কর্মক্ষেত্রে ততটা নয় কেন? এ বিষয়ে সোহরাব হাসান স্পষ্টতই বলেছেন, ‘আমাদের সমাজে মেয়েদের চলার পথে পদে পদে বাধা। এ কারণে মেয়েদের শিক্ষার হার বাড়লেও কর্মক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে আছেন। একসময় এনজিওতে বিপুল মেয়ে কাজ করতেন। এখন তাদের কার্যক্রমও সীমিত হয়ে আসছে।’
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, একটি সমাজ নারীর প্রতি কী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে, তার ওপর নির্ভর করে পেশাগত জীবনে অংশগ্রহণ। আমাদের সমাজে নারীকে কীভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় কিংবা সমাজের কাছে নারীর ভাবমূর্তি কেমন- এমন সাতটি পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সমাজ মনে করে, ‘১. মেয়েরা ঘরের শোভা, ২. যতই শিক্ষিত হোক বা চাকরি করুক মেয়েদের আসল কাজ ঘরে, ৩. বাচ্চা, স্বামী ও স্ব^ামীর পরিবারের কাজ ঠিক রেখে চাকরি করতে পারলে করুক, ৪. ভালো মেয়ে : নরম, নমনীয়, কমনীয়, দুর্বল, চাপা, স্বামী বা পরিবারের ইচ্ছার কাছে সমর্পিত, ৫. মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে শারীরিকভাবে দুর্বল এবং মেধা, মনন ও কর্মক্ষমতার দিক থেকে নিকৃষ্ট, ৬. স্বামীর পায়ের নিচে স্ত্রীর বেহেশত, ৭. নিয়ন্ত্রণ না করলে মেয়েরা বিপজ্জনক ইত্যাদি’ (আনু মুহাম্মদ, ‘নারী, পুরুষ ও সমাজ’; পৃষ্ঠা : ১১৯)।
আমাদের আলোচনার ক্ষেত্রে ৩নং দৃষ্টিভঙ্গিটি বেশি প্রযোজ্য। আমরা মনে করে থাকি নারী বাইরে যেতে পারবে গৃহস্থালির সব কাজ সমাপ্ত করার পর। একই মর্যাদার, একই আয়ের, একই পরিশ্রমের স্বামী-স্ত্রী সকাল ৮টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যান; সারা দিন কাজ শেষে একই সঙ্গে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন; বাসায় ফিরে স্বামী স্ত্রীকে বলেন, দারুণ ক্লান্ত, এক কাপ চা দাও তো। এখানে সমান পরিশ্রম সত্ত্বেও নারীর ক্লান্তিকে আমলে নেয়া হয় না।
টানাটানির সংসার যখনই একটুখানি সচ্ছলতার মুখ দেখে, তখনই প্রস্তাব তোলা হয় স্ত্রী যেন চাকরি ছেড়ে দেয়। সন্তান লালনপালনের সব দায়ই পড়ে নারীর ওপর। অনেক মেয়েই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বিবাহজনিত কারণে, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য নয়। কারণ বিয়ের বাজারে পুরুষ শিক্ষিত পাত্রী খোঁজে তাদের সন্তানদের ঠিকমতো দেখভাল করার জন্য। তার মানে নারী কতখানি শিক্ষিত হবে এবং সে শিক্ষা কোন কাজে লাগবে, তা নির্ধারণের মালিক এখনও পুরুষ, নারী নয়।
পেটের জন্য কাজ, আর্থিক সচ্ছলতার জন্য কাজ। শুধু কি তাই? নারীর অর্জিত মেধা-জ্ঞানকে সামাজিক বিকাশের সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারলে একটি ভারসাম্যমূলক সমাজব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে কি? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে প্রচুর পরিমাণে ভর্তুকি দিতে হয়। সে ভর্তুকি দেয়ার উদ্দেশ্য একটাই- সমাজ ও জাতি গঠনের সহায়ক শক্তি তৈরি করা। কিন্তু নারীর প্রতি যদি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা না যায়, তাহলে শিক্ষিত করার ভেতর দিয়ে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে এইচএসসি পাস করা মেয়েদের উচ্ছল হাসিটুকুনই হবে তাদের জীবনের শেষ হাসি।
লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়