সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের শিশু-কিশোর ও তরুণদের ওপরও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বর্তমানে একেবারে প্রাইমারি থেকেই অনেক শিশু প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থীই ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত। নিজেদের পাঠ্যবইয়ে যা আছে তার চেয়েও অনেক বেশি আধুনিক তথ্য তারা ইন্টারনেট ব্যবহার করেই পাচ্ছে। পৃথিবীর কোথায় কী আছে, কোথায় কী নেই, কোথায় কী ঘটছে বা ঘটেছিল বা ভবিষ্যতে কী ঘটতে পারে, বিভিন্ন দেশের শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস, সাহিত্য ইত্যাদি সম্পর্কে আজকের শিশু-কিশোর ও তরুণরা ঘরে বসেই দেখছে, শুনছে ও জানতে পারছে।
এ কারণেই দিন দিন শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠ্যবইয়ের চেয়ে ইন্টারনেটযুক্ত স্মার্টফোনই প্রিয় হয়ে উঠছে। তাদের মনের চিন্তা-ভাবনাগুলোও খুব সহজেই অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে পারছে। তারা এখন বইয়ের টেবিলে না বসে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদি নিয়েই বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে। কিন্তু ইন্টারনেট লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা ও পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারছে না। শিক্ষার্থীদের মন-মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন ঘটলেও শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। পরীক্ষা পাস ও জিপিএ-৫ সহজলভ্য হওয়ায় লাখ লাখ পরীক্ষার্থী পাস করছে, ভালো ফলাফলও করছে। এতে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা, শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবাই খুশি। কিন্তু দেশের শিক্ষা ও পরীক্ষার মান যে কত নিচে নেমে যাচ্ছে, তা বোঝা যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে।
আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নসহ মানুষের জীবনযাত্রার সার্বিক উন্নয়নের প্রভাব শিশু-কিশোর ও তরুণদের জীবনকেও প্রভাবিত করছে। তাদের জীবন-যাপন পদ্ধতি, চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের প্রযুক্তি প্রভাবিত শিক্ষার্থীরা সেই মান্ধাতার আমলের শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারছে না। মেধা বিকাশের পরিবর্তে জিপিএর প্রতিই সকলের আগ্রহ। যার ফলে দিন দিন শিক্ষার্থীরা মেধাবী হওয়ার পরিবর্তে মেধাহীন হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিককালে পাঠ্যবই এবং শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন করা হলেও তা যুগোপযোগী হয়নি। ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যবস্থা বর্তমান যুগে একেবারেই অচল। তরুণ শিক্ষার্থীদের ওপর তথ্যপ্রযুক্তির প্রভাব বিবেচনায় রেখেই শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এখন সময়ের দাবি।
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও ধর্ম এই চারটি প্রধান বিষয় থাকবে। আর বিজ্ঞান, সমাজ ও তথ্যপ্রযুক্তি এই তিনটি বিষয় শ্রেণিকক্ষে পড়াতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। পাবলিক পরীক্ষা হবে প্রধান চারটি বিষয়ের ওপর ৪০০ নম্বরে। এসএসসি পাস করার পর শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা ও পছন্দ অনুযায়ী বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসা শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হবে। দশম শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর জন্য একই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকবে। যেহেতু আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, তাই শুধু বাংলা বিষয়ের সৃজনশীল পদ্ধতি রাখতে হবে এবং অন্য বিষয়গুলোর সৃজনশীল পদ্ধতি বাতিল করতে হবে। এছাড়া বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পুরো শিক্ষাব্যবস্থাই কোচিং ও পরীক্ষা নির্ভর হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছরে দুটি পরীক্ষা নেওয়ার সরকারি নির্দেশ অমান্য করে বছরে চার-পাঁচটি পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। আবার এর সঙ্গে রয়েছে মোটা অঙ্কের ফি আদায়ের ব্যবস্থা। যে কোনো মূল্যে শিক্ষার্থীদের এই কোচিং ও অতিরিক্ত পরীক্ষার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হবে। শ্রেণিকক্ষেই সম্পন্ন করতে হবে শিক্ষা।
ফরিদপুর