শূন্যপদের চাহিদা দেয়া নিশ্চিতকরণ ও নিবন্ধিতদের নিয়োগ প্রসঙ্গে - দৈনিকশিক্ষা

শূন্যপদের চাহিদা দেয়া নিশ্চিতকরণ ও নিবন্ধিতদের নিয়োগ প্রসঙ্গে

এম. নাজমুল হাসান গোলজার |

শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয় তাহলে শিক্ষার মেরুদণ্ড শিক্ষক। একজন শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায়-নীতিবান, আদর্শবান, দেশ প্রেমিক, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের কতটুকু দায়িত্বশীল হবে, কতটুকু দায়িত্ব পালন করবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর সুশিক্ষার উপর। আর এ সুশিক্ষা যিনি দিয়ে থাকেন তিনিই আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। তাই এ পেশাকে বলা হয় মহান পেশা।

আরও পড়ুন : লেখা আহ্বান: আমার জন্য একটু রেখো ঈদের আয়োজন!

এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা দুই ধরনের- সরকারি ও বেসরকারি। দেশ স্বাধীনের আগে থেকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতা ছিল প্রতিষ্ঠাতাদের হাতে। পরে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির প্রচলন হলে তারা দৈনিক  পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিধি-বিধান মোতাবেক শিক্ষক নিয়োগ দিতেন। এতে কোথাও কোথাও  রাজনৈতিক প্রভাব, মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি তাদের নিকট আত্মীয় ও অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অভিযোগ থাকত। এতে কোথাও কোথাও মানসম্মত ও যোগ্য শিক্ষকরা নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হতেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগের জন্য একটি মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল ২০০৫ সালে। আশা ছিল- স্থানীয় প্রভাবশালীর প্রভাব, তাদের আত্মীয় স্বজন ও রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত হয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যোগ্য ও উপযুক্ত শিক্ষক পাবে। যদিও শুধু এই একটি মাত্র বিষয় যোগ্য ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। তারপরও এটি একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। সেই উদ্যোগের ধারাবাহিতকতায় মানসম্মত ও যোগ্য শিক্ষক পাবার আশায় ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে একটি বিশেষ আইনের মাধ্যমে এনটিআরসিএ গঠন করে সরকার। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনটিআরসিএ একটি আধা-স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো বাংলাদেশের প্রায় ৩৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এন্ট্রি লেভেল শিক্ষক নিয়োগের লক্ষ্যে প্রার্থী বাছাই করা। ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির অধীনে ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম কাজ করে। তৎকালীন শিক্ষাসচিব ও বর্তমানে দৈনিক শিক্ষার প্রধান উপদেষ্টা মো: নজরুল ইসলাম খান ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের একটি বিশেষ গেজেটের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির এন্ট্রি লেভেল শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতাকে খর্ব করে শূন্য পদে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ শুরু করেন। যদিও এর বিরোধীতা করেন অধিকাংশ সংসদ সদস্য। এমনকি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীও কিছুটা উদাসীন ছিলেন বলে অভিযোগ ছিলো।  এনটিআরসিএ সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হতে শূন্য পদের চাহিদা উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে গ্রহণ করে। শূন্য পদের চাহিদা পূরণ করার জন্য উপজেলা কর্মকর্তাসহ প্রতিষ্ঠান প্রধানের পত্র ইস্যু বা ক্ষুদে বার্তায় অবগত করে থাকে। বেশির ভাগ সম্মানিত প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বিগত ৪ বছর যথা সময়ের মধ্যে এনটিআরসিএতে বিধি মোতাবেক শূন্য পদের চাহিদা জমা দেননি কিংবা দিলেও অনেক কম জমা দিয়েছেন।

শূন্য পদের চাহিদা না দিয়ে অনিবন্ধিত ও অযোগ্য খণ্ডকালীন শিক্ষক বা এক বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে অন্য বিষয়ের পাঠদান করাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা। তাদের ধারণা- নিয়োগদানের ক্ষমতা আগের মতো ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডির হাতে ফেরত আসবে। আবার তারা পূর্বের ন্যায় ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে অনিবন্ধিত ও অযোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে পারবেন। এসবই গুড়ে বালি হবে। পাহাড়াদার হিসেবে সজাগ রয়েছে দৈনিক শিক্ষাডটকম। 

শিক্ষার মান নিশ্চিতকরণে শিক্ষাবান্ধব এ সরকার বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার মধ্যে অন্যতম বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা। অনিবন্ধিত ও খণ্ডকালীন শিক্ষকদের জন্য সরকারিভাবে শিক্ষকের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই খণ্ডকালীন ও অনিবন্ধিত শিক্ষকদের জন্য শিক্ষার মান নিম্নগামী হচ্ছে। খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে কখনো স্থায়ীভাবে শিক্ষার মান উন্নতি করা সম্ভব নয়।

শিক্ষক যখন দুর্বল হয়, প্রজন্ম তখন দুর্বল শিক্ষা পায়। মানুষ অনুকরণ প্রিয়, অনুকরণ থেকেই সে শেখে। আর শেখার প্রাতিষ্ঠানিক স্থানটি হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে শিক্ষক যা বলেন শিক্ষার্থীরা তা অনুকরণ করে শিখতে চায়। শিক্ষকের জানার ও বুঝানোর পরিধি সংকীর্ণ হলে প্রতিফলনও সংকীর্ণ হবে। খণ্ডকালীন শিক্ষক ও ক্লাসে তাদের পাঠদানের ব্যাপারে ভেবে দেখার সময় এসেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। 

দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকদের অভাবে দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে পাঠদানের স্বাভাবিক কার্যক্রম। ওদিকে শিক্ষক নিবন্ধন সনদকারীরা নিয়োগ লাভের আশায় চাতক পাখির মতো অপেক্ষায় আছে। এরই মধ্যে অনেকের বয়স ৩৫ বছর পার হয়ে গেছে। যার কারণে নিয়োগ লাভে তারা বাদ পড়ছেন। ৩৫ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের কাছে প্রতিটি দিন যেন এক-একটি বছরের সমান মনে হচ্ছে। নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষক নিবন্ধন সনদকারীদের হতাশা ও আবেগের কোনো মূল্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশেষ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছে নেই বললেই চলে।

এনটিআরসিএ’র অধীনে গত ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অদ্যাবধি প্রায় সাড়ে ৬ লাখ নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। নিয়োগ প্রত্যাশীদের মধ্য থেকে বিভিন্ন কারণে নিয়োগ না পেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এক পর্যায়ে রিট এবং মামলায় যেতে হয় তাদের। গত বছর মাননীয় হাইকোর্ট মামলাগুলোর ওপর রায় প্রদান করেন এবং উত্তীর্ণদের নিয়ে জাতীয় মেধা তালিকা তৈরি করে আদালতে জমা এবং এনটিআরসিএ’র ওয়েব সাইটে প্রকাশের নির্দেশ দেন। রিটাকারীরা যা না চেয়েছেন তাও আদেশে অন্তভূক্ত ছিলো। সেটি হলো বয়সসীমা। আদালতের নির্দেশানুসারে এনটিআরসিএ ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই তারিখে একটি জাতীয় মেধা তালিকা প্রকাশ করেছেন। এ তালিকা প্রকাশের পর থেকেই সারা দেশের প্রায় ৫ লক্ষাধিক নিবন্ধিত শিক্ষকদের মধ্যে নিয়োগ পাওয়া নিয়ে আবারও নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে  অনেকেরে মধ্যে। যদিও বয়সের জটিলতায় পড়া রিটকারীরা যে একটি বড় ভুল করেছে তা তারা বুঝতে পারেননি। তারা যাদেরকে বিবাদী করা দরকার ছিলো তাদেরকে করেননি কতিপয় আইনজীবীর ভুল পরামর্শে। এ বিষয়টি এনটিআরসিএর বিদায়ী চেয়ারম্যান আশফাক হুসেন দৈনিক শিক্ষার সম্পাদককে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন।   

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা তার উজেলায় অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়টি শূন্য পদ রয়েছে তা ভালো করেই জানেন। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীর যোগ্য শিক্ষকের শূন্য পদ পূরণে তার অবশ্যই দায়বদ্ধতা রয়েছে। যদি তিনি তার উপজেলায় শূন্য পদ পূরণে একজন মডারেটর হিসেবে ই-রিকুইজেশন পূরণ না করা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের তলব করে শূন্য পদের চাহিদা দিতে নির্দেশ প্রদান এবং বাধ্য করেন তাহলে অতি কম সময়ের মধ্যে সমুদয় শূন্যপদ পাওয়া সম্ভব হবে। 

তাই যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শূন্যপদ রয়েছে তারা অবশ্যই পরবর্তী সময়ের মধ্যে সঠিক শূন্যপদের তথ্য প্রদান করুন।  দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আসবে আমূল পরিবর্তন। এতে সব প্রতিষ্ঠানও পাবে যোগ্য শিক্ষক। ক্লাসে মানসম্মত পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারে ওরা আপনার, আমার সারথী হবে এবং এদের দ্বারাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে নতুনভাবে নবরূপে শিক্ষাকে রূপ মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। পরিশেষে নিবন্ধিত মেধাবী সনদধারী বেকারদের নিয়োগ নিশ্চিতকরণে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শূন্য পদ প্রদানে আন্তরিকতা এবং এনটিআরসি এর কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। 

লেখক : এম. নাজমুল হাসান গোলজার, প্রভাষক, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ, তেঁতুলঝোড়া কলেজ, সাভার, ঢাকা।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0079679489135742