‘আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’ - দৈনিকশিক্ষা

‘আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই’

তোফায়েল আহমেদ |

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ছিল শুক্রবার। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় আমি আর মণি ভাই বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেই। রাত ১২টায় মুহুর্মুহু গোলাবর্ষণের মধ্যদিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ অনুযায়ী জিরো আওয়ারে শুরু করে বাঙালি নিধনে গণহত্যা। যা অখ- পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। বঙ্গবন্ধু ঘোষিত শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবিকে সশস্ত্রপন্থায় নিশ্চিহ্ন করতেই এ গণহত্যা। চারদিকে প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে তখন বাজছে বিদায় বেলায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ, ‘তোমাদের যে দায়িত্ব আমি দিয়েছি, সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন কর। আমার জন্য ভেব না। আমি যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, আমার স্বপ্নের সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই হবে। ওরা অত্যাচার করবে, নির্যাতন করবে।

কিন্তু আমার বাংলাদেশের মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না।’ বর্বর পাকিস্তান বাহিনী বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। মার্চের ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই সারা দেশসহ ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। এ অবস্থায় রাতে খবর পেলাম বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সকালে ইয়াহিয়া খান তার ভাষণে সারা দেশে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘সপ্তাহখানেক আগেই আমার উচিত ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা...। ...কেননা কয়েকটি শর্ত দিয়ে সে আমাকে ট্র্যাপে ফেলতে চেয়েছিল। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সে আক্রমণ করেছে, এই অপরাধ বিনা শাস্তিতে যেতে দেওয়া হবে না।’ ২৭ মার্চ যখন দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়, তখন আমি আর মণি ভাই গুলিস্তান দিয়ে নবাবপুর রোড ধরে সদরঘাট গিয়ে কেরানীগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করি। পেছনে পড়ে থাকে ধ্বংস আর মৃত্যু উপত্যকাসম রক্তাক্ত ঢাকা নগরী। যাওয়ার সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে দফায় দফায় প্রচারিত এম এ হান্নান সাহেবের ভাষণ শুনি, ‘কে বলে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়েছে? তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন।’ সকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান সাহেব এবং অন্যান্য নেতা বিরামহীনভাবে ঘোষণা দিতে থাকেন, ‘বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে প্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।’ এরপর সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারিত হয়।

টানা ২৪ দিন চলা সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন আর বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে অবশেষে গণহত্যার দিকে এগিয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ২৫ মার্চ জিরো আওয়ারে গণহত্যা শুরুর আধঘণ্টার মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন!’ স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যখন প্রথম গুলিটি বর্ষিত হলো, ঠিক সেই মুহূর্তে পাকিস্তান রেডিওর সরকারি তরঙ্গের কাছাকাছি একটি তরঙ্গ থেকে ক্ষীণস্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ওই কণ্ঠের বাণী মনে হলো পূর্বেই রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। তাতে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন।’ স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন, ‘‘ঘোষণায় বলা হয়, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।”

বিগত ২৪ বছরের মুক্তিসংগ্রাম আর ’৭১-এর ২ মার্চে শুরু হওয়া ২৪ দিনের নিয়মতান্ত্রিক অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধুকে কোনোরূপ আপস-মীমাংসায় আনতে অক্ষম হয়ে অবশেষে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চরম নিষ্ঠুরতায় বাঙালি নিধনে গণহত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। নির্মম এ হত্যাকা- শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত শেষ বার্তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য এরকম একটি চূড়ান্ত ঘোষণা দেওয়ার উত্তুঙ্গ অবস্থায় পৌঁছতে বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ ২৪টি বছর ধরে নিজকে, দলকে এবং বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যদিয়ে লক্ষ্যস্থির করে, ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে, জেল-জুলুম-হুলিয়া, ফাঁসির মঞ্চকে উপেক্ষা করে মৃত্যুঞ্জয়ী শক্তি নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়েছে। একদিনে হয়নি। বহু বছর ধরে, অগণিত মানুষের আত্মদানের মধ্যদিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি আজ প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের ঘোষণাকে শিরোধার্য করেছে। তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ তারিখে মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ৬নং প্যারায় অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করেছে।

স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল মূলত ছয় দফা দেওয়ার মধ্যদিয়েই। ছয় দফাই ছিল স্বাধীনতার বীজমন্ত্র। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ ছয় দফাকে প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু ছয় দফার প্রতি বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় স্থির-প্রতীজ্ঞাবোধ তাঁকে জনমনে জনগণমন অধিনায়কের আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। আর আমরা যারা ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম তারা ’৬৯-এর জানুয়ারির ৪ তারিখে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ছয় দফাকে দাড়ি, কমা, সেমিকোলনসমেত ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে সারা বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-শহরে-বন্দরে-কলে-কারখানায় ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে ১১ দফা আন্দোলনের স্বপক্ষে সারা দেশে গণজোয়ার তৈরি হয় এবং বৈপ্লবিক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এমতাবস্থায় শাসকশ্রেণি আমাদের আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিত্রিত করার প্রয়াস পায়।
১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্বাচনী সফরসঙ্গী হয়ে সারা দেশ সফর করেছি। নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিতে, গণরায় নিতে প্রতিটি সভায় তিনি বলতেন, ‘এ নির্বাচন বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে গণভোট। আপনাদের অধিকার আদায়ের জন্য আমি যদি আমার জীবনের যৌবন পাকিস্তানের কারাগারে কাটাতে পারি, ফাঁসির মঞ্চে যেতে পারি, তবে কি আমি আপনাদের কাছে আমার ৬ দফার পক্ষে একটি ভোট চাইতে পারি না।’ মানুষ দু’হাত তুলে তাঁকে সমর্থন জানাতো। নির্বাচন উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন, ‘...আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি, যে কর্মসূচি ১১ দফা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সে কর্মসূচি আঞ্চলিক অন্যায়-অবিচারের বাস্তব সমাধানের পথনির্দেশ করেছে। ...আগামী নির্বাচনে জাতীয় মৌলিক সমস্যাগুলো বিশেষ করে ৬ দফার ভিত্তিতে আমরা গ্রহণ করেছি।’ এভাবেই বাংলাসহ সমগ্র বিশ্বের কাছে ’৭০-এর নির্বাচনকে ৬ দফার রেফারেন্ডামে পরিণত করে নির্বাচনী অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ।

’৭০-এর দুর্যোগকবলিত এলাকাসমূহে ১০ দিনের সফর ও রিলিফ বিতরণ শেষে ঢাকায় ফিরে ২৬ নভেম্বর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কয়েকশ সাংবাদিকসহ জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...আমরা এখন নিশ্চিত যে, প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাংলাদেশের জনগণকে বাঁচতে হলে ৬ দফা আর ১১ দফার ভিত্তিতে আমাদের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতেই হবে।’ সব নির্বাচনী সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু আর কখনই পূর্ব পাকিস্তান বলেননি, সর্বত্র ‘বাংলাদেশ’ বলেছেন। এরপর যথাসময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ তাদের রায় জানিয়ে দিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।

বাংলার মানুষের স্বাধিকারের দাবিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা-বিবৃতির বিপরীতে ভুট্টো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করেন। আর বঙ্গবন্ধু জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড় করেন। ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক রেসকোর্সে অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করাবেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাঁকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ জেনারেল ইয়াহিয়া ’৭১-এর ১১ জানুয়ারি ঢাকায় এসে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি দুদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দু’দফা আলোচনায় মিলিত হন। ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব তাঁর সঙ্গে আলোচনা সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা পুরোপুরি সঠিক।’ ঢাকা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খান লারকানায় ভুট্টোর বাসভবনে যান এবং সেখানে জেনারেলদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। মূলত লারকানা বৈঠকেই নির্বাচনী ফলাফল বানচালের নীলনকশা প্রণীত হয়।

এরপর ১৩ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি ঘোষণায় জানানো হয়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৩ মার্চ বুধবার ৯টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেছেন। এদিকে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। ওয়ার্কিং কমিটি আলোচনা অনুমোদন করে এবং বঙ্গবন্ধুকে ‘জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ও অধিকার আদায়ের জন্য যে কোনো পন্থা গ্রহণের পূর্ণ অধিকার প্রদান করে।’ ১৫ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চক্রান্তকারীদের হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘ফ্যাসিস্টপন্থা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নিয়ে দেশের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখুন। জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যবস্থা বানচাল করার যে কোনো উদ্দেশ্যে তৎপর গণতান্ত্রিক রায় নস্যাৎকারীগণ আগুন নিয়ে খেলবেন না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দেওয়া অধিকার বলে আমরা ৬ দফার ভিত্তিতেই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করব। সাত কোটি বাঙালির বুকে মেশিনগান বসিয়েও কেউ ঠেকাতে পারবা না।’

একইদিনে ভুট্টো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের ৬ দফার ব্যাপারে আপস বা পুনর্বিন্যাসের আশ্বাস পাওয়া না গেলে তার দল জাতীয় পরিষদের আসন্ন ঢাকা অধিবেশনে যোগদান করতে পারবে না।’ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করতে অস্বীকার জ্ঞাপন করলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয়াদি নিয়ে আলোচনার জন্য ভুট্টোকে আমন্ত্রণ জানান। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে ৫ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ জানুয়ারির লারকানা বৈঠক এবং ১৯ ফেব্রুয়ারির রাওয়ালপিন্ডি বৈঠকেই গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। পিন্ডি থেকে করাচি ফিরে ভুট্টো স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই।’ ক্রমেই এটা স্বতঃস্পষ্ট হয়ে ওঠে, সামরিক চক্র ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির গণরায় বানচাল করার জন্য ভুট্টোর সঙ্গে একত্রে খলনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে।

২৬ ফেব্রুয়ারি করাচি প্রেসিডেন্ট হাউসে পুনরায় ভুট্টো-ইয়াহিয়া শলাপরামর্শ শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা সভায় প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের আহ্বান জানান। একই দিন লাহোরে এক জনসভায় ভুট্টো হুমকি দেন, ‘তার দলের কোনো সদস্য যদি পরিষদ অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে দলের সদস্যরা তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে।’

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের পূর্ব প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের এহেন বক্তব্যে তাৎক্ষণিক ক্ষোভ-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা নগরী। এদিন হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় ৬ দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে চারদিক প্রকম্পিত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘অধিবেশন বন্ধ করার ঘোষণায় সারা দেশের জনগণ ক্ষুব্ধ। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রাম করেই মুক্তি আনব। আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকুন।’ বিকাল ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পল্টন ময়দানের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভার জনসমুদ্রের উদ্দেশে বলি, ‘আর ৬ দফা ও ১১ দফা নয়। এবার বাংলার মানুষ এক দফার সংগ্রাম শুরু করবে। আর এই এক দফা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আজ আমরাও শপথ নিলাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।’ বঙ্গবন্ধু নির্দেশ না দিলে তো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদই গঠিত হতো না। পতাকা তোলার প্রশ্ন তো অবান্তর। সমগ্র জাতিসহ গোটা বিশ্ব তাকিয়ে ছিল বঙ্গবন্ধুর দিকে। তিনি ছিলেন জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা।

বাংলার মানুষের অধিকার বিসর্জন দিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনই ভাবেননি তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক বক্তৃতায় সে-কথা তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না; আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই।’ তিনি তো ’৭১-এর ১৭ মার্চ তার ৫২তম জন্মদিনে পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিয়েছিলেন, ‘আমার জীবন আমি জনগণের জন্য উৎসর্গ করেছি।’ সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুর জীবন জনগণের জন্য উৎসর্গিত ছিল এবং জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করেছেন। সব সময় লক্ষ্য করেছি, বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনমনীয় মনোভাব ছিল। তিনি মৃত্যুকে কখনই ভয় পেতেন না। সব সময় মৃত্যুর জন্য নিজকে প্রস্তুত রাখতেন। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে ’৭১-এর পঁচিশে মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে জীবনানন্দ দাশের কবিতা উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, “যদি বেঁচে থাকি, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়...’।” ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর, মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করি প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা। দেশ স্বাধীনের পর দেশবাসীসহ সমগ্র বিশ্ববাসীর দোয়া ও আশীর্বাদে পাকিস্তানের জিন্দানখানা থেকে মুক্ত হয়ে ’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সেদিন পরিপূর্ণতা লাভ করে।

স্বাধীনতার নির্মোহ ইতিহাস যারা বিশ্বাস করেন না, তারা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না। এই স্বাধীনতাবিরোধীদের স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার কোনো সাংবিধানিক অধিকার থাকতে পারে না। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের নিয়ে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণœ রেখে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে সম্মুখপানে, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে, সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে।

 

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।

 

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি - dainik shiksha আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046110153198242