গুজব-অপপ্রচারকে পেছনে ফেলে জয় হোক নতুন শিক্ষাক্রমের - দৈনিকশিক্ষা

গুজব-অপপ্রচারকে পেছনে ফেলে জয় হোক নতুন শিক্ষাক্রমের

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে খণ্ড নাটক, চিত্রায়ন এবং প্রতিষ্ঠানে অভিভাবক সমাবেশ করলে সুফল আসবে দ্রুত। পাশাপাশি কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং উপযোগী সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এসাইনমেন্ট ও হোমওয়ার্ক তৈরির সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষার্থীকে দেওয়া উচিত বাঙালির ইতিহাসে কোনো বিজয়ই সহজে আসেনি। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা এবং রক্তের বিনিময়ে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিজয় এসেছিল। কিন্তু সইতে হয়েছে কত লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও নির্যাতন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের এক মর্মান্তিক, হৃদয়স্পর্শী ও ন্যক্কারজনক ঘটনা। কত ত্যাগ, রক্ত ও স্বজন হারানো বেদনার পাশাপাশি সশস্ত্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র বাঙালির ভয়াবহ যুদ্ধের এক বিশাল ভা-ার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এসব ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অগণিত মা-বোনের সম্ভ্রম হারানো ছাড়াও সহ্য করতে হয়েছে নানা রকম গুজব ও অপপ্রচার, যা এখনো চলমান। মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি গুজব ও অপপ্রচার চালানো হতো ধর্মকে ব্যবহার করে। মৌলবাদীরা কথায় কথায় ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে আসছে। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ, ধর্মীয় গুরু ও শিক্ষাবিদদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও পরিচর্যায় এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধের পর সাম্প্রতিক সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার এবং অপপ্রচার হয়েছে পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে। ঘুষ ও অর্থ কেলেঙ্কারির মিথ্যা অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবকে পদত্যাগও করতে হয়েছিল। অথচ তদন্ত শেষে দেখা গেছে, এসবই ছিল গুজব ও মিথ্যাচার।

অবশেষে সকল গুজব ও অপপ্রচার পেছনে ফেলে বীর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধেও বিজয়ী হয়েছিল। পদ্মা সেতুও আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বের এক বিস্ময়। ইদানীং সবচেয়ে বেশি অপপ্রচার ও গুজব চলছে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে। অনেকেই মনগড়া মন্তব্য, টিকটক, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার করছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।
হাস্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় যেমন- আলু ভর্তা, ডিম ভাজি, পেক-পেক ব্যাঙের ডাক, ক্রিং-ক্রিং সাইকেল চালানো ইত্যাদি নিয়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নাকি বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এমনকি পাঠ্যসূচিতে বলা হয়নি, ছবিও নেই এমন কিছুও ফটোশপের মাধ্যমে এডিট করে বইয়ের অংশ বলে করা হচ্ছে অপপ্রচার। আসলে নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করতে নিরুৎসাহিত করেছে। কারণ, আগে যেগুলো মুখস্থ করতে হতো, এখন তা তারা হাতে কলমে শিখছে।

যেমন- খাবার স্যালাইন বানানো। এক চিমটি লবণ, এক মুঠো গুড় এবং আধা কেজি পানি পরিষ্কার গ্লাসে রেখে একটি চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করে তৈরির বর্ণনা বইয়ে পড়ার চেয়ে সরাসরি ক্লাসে বা ল্যাবে বানাতে পারলে সহজেই তা আয়ত্ত হবে, মনেও থাকবে। একইভাবে শরীরের প্রেসার মাপা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে ধারণা নেওয়া, পানি-ভূমির

মাপ শেখা, টাকা-পয়সা ও ব্যাংকিং হিসাব করা, রান্নাবান্নার প্রাথমিক ধারণা নেওয়া ইত্যাদি পাঠ্যপুস্তকে পড়ে শেখা যতটা কষ্টকর, হাতে-কলমে শেখা ততই সহজ। আবার গল্প, রচনা, ছড়া, কবিতা  ইত্যাদি অভিনয়, নাটক কিংবা মুরব্বিদের কাছে শুনে শেখা কতই না মধুময়। বড়দের সম্মান করা, ছোটদের ¯েœœহ করা, রাস্তায় ট্রাফিক আইন মেনে চলা ইত্যাদি মানবিক ও মূল্যবোধের বিষয়গুলো বড়দের কাছ থেকে শেখা যত সহজ, বইয়ের বর্ণনায় ততই কঠিন। তাই বলে বই পড়তে হবে না কিংবা মুখস্থ করতে হবে না- এমনটি কিন্তু নয়।

বারো মাসের নাম বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় কিংবা জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ইত্যাদি মুখস্থ করতে হবে। আবার যে কোনো খেলার কৌশল অনুসরণ ও চর্চা করেই রপ্ত করতে হয়, বই পড়ে মুখস্থ করে নয়। বিখ্যাত ক্রিকেটার কিংবা অভিনয় শিল্পীর নিজ নিজ পেশায় উচ্চতর কোনো ডিগ্রি নেই, আছে মঞ্চে অভিনয় কিংবা মাঠে খেলার অভিজ্ঞতা। এটাই স্পষ্ট করা হয়েছে বর্তমান কারিকুলামে। 

কোনো গান যে কোনো শিশু মুখস্থ করতে পারে অনায়াসে, যদিও সে একটি শব্দের অর্থও বোঝে না। কিন্তু শিশুটি কোনো নৃত্যশিল্পীকে অনুকরণ করে ওই গানের সঙ্গে নাচতে পারে সহজেই। তাহলে এখানে কোনো শিক্ষাটা তার জন্য উপযুক্ত হলো মুখস্থ নাকি অনুকরণ? আগের পাঠ্যসূচিতে এমন কিছু ছিল যা মুখস্থ করা হতো শুধু পরীক্ষার খাতায় লেখার জন্য। পরীক্ষার পর ওগুলোর কোনো প্রয়োগ ছিল না। কিন্তু এখন যা আছে বা শিখছে তা পরীক্ষার পরও বাস্তব জীবনে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। ফলে, সহজেই তা মুখস্থ হয় এবং সারাজীবন মনে থাকবে।

পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে সেগুলো হলো- একের প্রতি অপরের শেয়ারিং, কেয়ারিং, সহানুভূতি, মমতাবোধ ইত্যাদি। ফলে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দায়িত্বশীলতার চর্চা। প্রচলিত শিক্ষায় আমরা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে বড় হয়েছি। সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে এই মানসিকতায়। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতার মাধ্যমেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছা যায়, সে প্রচেষ্টা রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থী যখন বুঝতে পারবে যে, তার পড়ালেখায় কোনো প্রতিযোগিতা নেই, আছে অবাধ সহযোগিতা ও সহমর্মিতা, তাহলে অবশ্যই সে আনন্দ পাবে, আগ্রহী হবে এবং সম্মুখে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পাবে।

যা তাকে সহায়তা করবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী সৈনিক তৈরিতে। তাহলে কিসের ভয় এবং কেনই বা এত গুজব?
প্রচলিত শিক্ষায় অর্জিত জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে খুব একটা বেশি প্রয়োগ হয় না। স্বাধীনতার অর্ধযুগের পর বর্তমান কারিকুলামে এই বিষয়টি যতটুকু সম্ভব ম্যাপিং করা হয়েছে। সেজন্য এখানে শিক্ষার্থীদের অ্যাপ্লাইড নলেজ (প্রায়োগিক বিদ্যা) শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাতে শিক্ষার্থীরা অনাগত ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক পরিবেশে জনমানুষের জীবন মান উন্নয়নে নিজেদের বুদ্ধি, চিন্তা ও বিবেচনা (কগনেটিভ ডোমেইন) দিয়ে কর্মমুখী হতে পারে।

এছাড়াও শিক্ষার্থীর মূল্যবোধ, আবেগ, অনুভব-অনুভূতি, উৎসাহ-উদ্দীপনা, স্বভাব-চরিত্র, দৃষ্টিভঙ্গি (অ্যাফেক্টিভ ডোমেইন) ইত্যাদি পরিমাপ করার পদ্ধতি এতদিনের লিখিত পরীক্ষায় ছিল না, যা এখন বিদ্যমান। আবার অর্জিত জ্ঞান দিয়ে কর্ম সম্পাদনের জন্য যেমন দরকার সতেজ মন ও সক্রিয়তা, তেমনি মানসিকতা ও দক্ষতা (সাইকোমটর ডোমেইন)- তা তৈরির বিষয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পরিবারকে অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে নতুন কারিকুলামে। এভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক, পরীক্ষাবিহীন ও পরীক্ষাসহ সকল কর্মকাণ্ডকে ধারাবাহিক ও সামষ্টিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ফলে, দেখা যায় কোনো শিক্ষার্থীই প্রথম হয়নি, আবার কেউই ফেল করেনি। কেউ সংগীতপ্রেমী, কেউ খেলায় চ্যাম্পিয়ন, কেউ অংকে দক্ষ, কেউ সাহিত্যে, কেউ ড্রইংয়ে পটু আবার কেউ ভালো বক্তা, আছে নেতৃত্বের গুণাবলী, দেশপ্রেমে নিবেদিত।

অর্থাৎ একেকজন একেক বিষয়ে খুবই পারদর্শী এবং সবাই প্রথম, সবাই সমান এবং সকলেই একই মর্যাদার শিক্ষার্থী। তারা একে অপরের বন্ধু এবং সবাই সবাইকে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। তাহলে গুজবের পরিবর্তে এই শিক্ষাক্রমকে সাধুবাদ জানানো উচিত নয় কি? 
পরিবার পরিকল্পনার প্রকল্পটি যখন দেশে শুরু হয়, তখন এটিকে নাজায়েজ এবং ইসলামবিরোধী বলে অপপ্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু রেডিও এবং বিটিভিতে ছোট ছোট গল্প ও নাটিকার মাধ্যমে যখন এটাকে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিল, তখন মানুষ এর  প্রকৃত উদ্দেশ্য ও সুফল বুঝতে পেরেছে এবং একপর্যায়ে তা গ্রহণ  করেছে। একইভাবে বর্তমান শিক্ষা কারিকুলাম নিয়ে বিভিন্ন টেলিভিশনে খণ্ড নাটক, চিত্রায়ন এবং প্রতিষ্ঠানে অভিভাবক সমাবেশ করলে সুফল আসবে দ্রুত। পাশাপাশি কারিকুলাম অনুযায়ী শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং উপযোগী সুসজ্জিত শ্রেণিকক্ষ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। এসাইনমেন্ট ও হোমওয়ার্ক তৈরির সরঞ্জাম প্রতিষ্ঠান থেকেই শিক্ষার্থীকে দেওয়া উচিত।

অন্যথায় গরিব শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়বে। পরিশেষে বলা যায়, যে কোনো উন্নয়ন ও সংস্কারের শুরুতে বাধা আসবে। হবে নানা আলোচনা ও সমালোচনা। এসব অতিক্রম করেই আধুনিক শিক্ষাক্রমকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সমস্ত অর্জন ও বিজয়ে ছিল অসীম ধৈর্য এবং সাহস। এক্ষেত্রেও অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধৈর্য ধরতে হবে কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়ার জন্য। শিক্ষা হোক সাবলীল, জীবন ঘনিষ্ঠ এবং আনন্দময়। সকল গুজব ও অপপ্রচারকে পেছনে ফেলে জয় হোক নতুন শিক্ষাক্রমের।

লেখক : ড. এম. মেসবাহউদ্দিন সরকার, অধ্যাপক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, আইআইটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

দেরিতে এসে স্বপ্নভঙ্গ গুচ্ছে ভর্তিচ্ছু অনেকের - dainik shiksha দেরিতে এসে স্বপ্নভঙ্গ গুচ্ছে ভর্তিচ্ছু অনেকের নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ ৭ দাবিতে সরকারি কর্মচারীদের মানববন্ধন - dainik shiksha নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নসহ ৭ দাবিতে সরকারি কর্মচারীদের মানববন্ধন কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সম্মতি প্রধানমন্ত্রীর - dainik shiksha জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে সম্মতি প্রধানমন্ত্রীর প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিতের অভিযোগে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি গ্রেফতার - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে লাঞ্ছিতের অভিযোগে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি গ্রেফতার শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ নিজের শিক্ষককে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢাবি শিক্ষক, প্রশংসায় ভাসছে ফেসবুক - dainik shiksha নিজের শিক্ষককে নিয়ে শ্রেণিকক্ষে ঢাবি শিক্ষক, প্রশংসায় ভাসছে ফেসবুক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003026008605957