ছাত্রী নির্যাতন, হচ্ছেটা কী? - দৈনিকশিক্ষা

ছাত্রী নির্যাতন, হচ্ছেটা কী?

শাকিল কালাম |

এখন আমরা এক অস্থির সময় অতিক্র্ম করছি। দেশের জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চলছে টানাপোড়েন। নেই কোন পরমতসহিষ্ণুতা। রাজনীতির ভাষা হয়ে উঠেছে আক্রমণাত্মক। পরস্পরের প্রতি নেই কোনো  শ্রদ্ধাবোধ। চলছে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অপরদিকে, ছাত্ররাজনীতি সংগঠনগুলোর মধ্যেও নেই কোন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। যখন যে সরকার আসে, তখন সেই সরকারের ছাত্র সংগঠন বিশ্বব্যিালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ছাত্রছাত্রী হলসহ প্রশাসন এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের জিম্মাদার হয়ে উঠে। শুধু প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সমর্থকদের হল ছাড়া করা নয়, এমন কী নিজ ছাত্র  সংগঠনের বিভিন্ন উপদলের সমর্থকদেরও বিতাড়িত করে রাজনৈতিক দখলদারি প্রতিষ্ঠা  করতে গিয়ে নিবর্তনমূলক ও কুরুচিপূর্ণ আচরণ করে থাকে। এ ধরনের আদিম অমানবিক ও পৈশাচিক জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন সাধারণ ছাত্রছাত্রীসহ শিক্ষক, হল প্রভোষ্ট এবং ছাত্র উপদেষ্টারাও।

সম্প্রতি কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রথমবর্ষের এক নবীন ছাত্রী তাঁর সিনিয়র বোনদের দ্বারা নির্মম নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছেন। ইবি’র দেশরত্ন শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের গণরুমে ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা চৌধুরী অন্তরা এবং তাবাসসুম অনুসারীদের দ্বারা এ জঘন্য ঘটনা ঘটে। নেত্রীর কথা না শোনার অভিযোগে তাঁকে সাড়ে চার ঘন্টা আটকে রেখে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করা হয়। কেনো তাঁকে মারধর করা হচ্ছে-জানতে চাইলে নেত্রীরা তাঁর মুখ চেপে ধরে জোরে জোরে চোয়ালে চড়থাপ্পড় মারতে থাকেন। পা ধরে মাফ চাইতে গেলে একজন তাঁকে লাথি মারে এবং নির্বিচারে গালিগালাজ করতে থাকে। বুকে সজোরে লাথি মারে এবং গলায় গামছা দিয়ে ফাঁস দিয়ে ধরে রাখে। এরপর তারা তাকে জামা খুলতে বলে। কিন্তু জামা খুলতে না চাইলে জবরদস্তি তাঁকে বিবস্ত্র করে এবং ভিডিও ধারণসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। এমন কী এ ঘটনা কাউকে জানালে বা কোনোভাবে প্রকাশ পেলে তাঁকে প্রাণনাশের হুমকিও দেয়া হয়। বর্বরতার কোন পর্যায় গেলে কোন মানুষ এ ধরণের আচরণ করতে পারে! আমরা এ কোন সমাজে বসবাস করছি? এরপর অই ছাত্রী পালিয়ে হল থেকে বাড়ি চলে যান। এখানেই সানজিদার নিষ্ঠুরতার শুরু হয়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ছাত্রী একটি জাতীয় দৈনিককে জানান, এর আগেও আরো ৪ জন ছাত্রী তাঁর অত্যাচার/নির্যাতনের শিকার হন। 

পরবর্তীতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভিকটিম ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, হল প্রোভোস্ট  এবং ছাত্র উপদেষ্টার কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। অবশ্য ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা এ ধরনের অভিযোগের কোন সত্যতা নেই বলে জানান। অপরদিকে সানজিদাও ওই ছাত্রীর বিরুদ্ধে প্রক্টর, হল প্রোভোস্ট  এবং ছাত্র উপদেষ্টার কাছে লিখিতভাবে অভিযোগ করেন। তাছাড়া হলের আবাসিক ছাত্রীদের গণস্বাক্ষর নিয়ে আরো অভিযোগ দাখিল করেছেন।

নির্যাতিত ছাত্রীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হল কর্তৃপক্ষ পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন এবং পরবর্তী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। 

ছাত্রলীগ নেত্রী সানজিদা ইবি’র ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্রী। দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের ৪০৮ নম্বর রুমে থাকেন সানজিদা। তিনি ইবি শাখার ছাত্রলীগ সভাপতি ফায়সাল সিদ্দিকী আরাফাতের অনুসারী। ছাত্রলীগের আংশিক কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ লাভ করেন অন্তরা। এরপর থেকেই সানজিদা সবক্ষেত্রে দাপট দেখাতে শুরু করেন। ১৫/২০ জন অনুসারী নিয়ে হলের নিয়ন্ত্রণ নেন। তা বজায় রাখতেই সানজিদা সাধারণ ছাত্রীদের ওপর এমোন দাপট দেখান বলে অনেকেই মনে করেন।  হলের যে রুমে অন্তরা থাকেন সে বারান্দায় যাওয়াও বারণ আছে। আবার কেউ তাঁর সামনে গেলে তাকে মাথা নিচু করে থাকতে হয়, নয়তো তাকে অপদস্থ হতে হয়। 

গণমাধ্যমে এ বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের বিবেকবান মানুষ এবং সামাজিক সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, জাতীয় রাজনীতি এবং ছাত্র রাজনীতি-কোথাও গণতন্ত্রের চর্চা নেই। সে কারণে নানা অনাচার হচ্ছে। গণতন্ত্রের চর্চা না হলে ছাত্রসংগঠনের কর্মকান্ডে পরিবর্তন আসবে না। 

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তাঁদের বিবৃতিতে বলেছেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরণের ঘটনা (শিক্ষার্থী নির্যাতন) বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। মানবাধিকার কমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষার্থীরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাঁদের এমন বর্বর ও কুরুচিপূর্ণ আচরণ কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। এমোন কর্মকান্ড নিরসনের উপায় নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে। আইন ও সালিশী কেন্দ্র তাঁদের বিবৃতিতে বলেছে,সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাব এক্ষেত্রে দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ও নিরাপত্তা  বিধান করতে হবে। 

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ধরণের ঘটনা (শিক্ষার্থী নির্যাতন) বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা একটি জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তাঁদের এমোন বর্বর ও অশালীন আচরণ দুঃখজনক। এ হীন কর্মকান্ড সমাধানের উপায় নিয়ে সচেতন মানুষকে ভাবতে হবে। 
সামাজিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের অভাব এক্ষেত্রে দৃশ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য  শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষার পরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হবে। 

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবি গাজী মহসিন ওই ছাত্রীকে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। আদালত ৫টি নির্দেশনা দিয়ে রুল জারি করে।

হাইকোর্ট উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, এটি খুবই অ্যালার্মিং (উদ্বেগজনক) ওই মেয়ে ওখানে পড়তে পারবেন কী-না, তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। উল্লেখ্য, বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন। আদালতের মতো দেশের জনগণও উদ্বিগ্ন, মেয়েটি ইবি’তে নিরাপত্তার সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কী না? আমরাও বিশ্বাস করতে চাই, ইবি কর্তৃপক্ষ মেয়েটির ধারাবাহিক পড়াশোনা ও নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে  সচেষ্ট হবেন।

দীর্ঘদিন ধরে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। কখনো কখনো ঘটনায় জড়িতদের বহিষ্কারসহ আইনগত ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। তবুও ক্রমাগতভাবে অপরাধ কর্মকান্ড ঘটেই চলেছে। একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগের সুনাম রয়েছে। ধরণের কর্মকান্ড সংগঠন হিসেবে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তাই এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে এবং সংগঠনটির শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় সুষ্ঠু  তদন্ত করে দলীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

লেখক : শাকিল কালাম, কবি ও গবেষক

  

 

একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই - dainik shiksha একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন - dainik shiksha সাড়ে ৪ মাসে ১৮৮ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, বিশেষজ্ঞরা যেসব বিষয়কে দায়ী করছেন শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ - dainik shiksha শতভাগ ফেল স্কুল-মাদরাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার উদ্যোগ দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত শিক্ষা কর্মকর্তা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল - dainik shiksha শ্রীপুরে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর ভাইয়ের প্রার্থিতা বাতিল এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha বিএনপি-জামায়াত মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বন্ধ করে দেয় : প্রধানমন্ত্রী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.030117988586426