দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগে আমরা পেয়েছি প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন পাকিস্তানের কারাগারে। ফাঁসিকাষ্ঠের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তার জীবন। আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলো। জেলে বসেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের বিজয়ের কথা শুনে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলেন। আর তার পরিসমাপ্তি হয়েছিল বাঁধভাঙ্গা আনন্দ অশ্রু দিয়ে।
অবশেষে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ভারতে যাত্রা বিরতি শেষে ১০ জানুয়ারি বীর বেশে ফিরে এলেন প্রিয় মাতৃভূমি স্বপ্নের বাংলাদেশে। সেদিন লাখ লাখ জনতার সামনে তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে- বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি বার বার চোখ মুছে ছিলেন আর অতীতের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করছিলেন। তবে সব কিছুর অন্তরালে তার বুকের ভিতর যে স্বপ্ন, প্রত্যাশা, প্রতিজ্ঞা, তা হলো স্বপ্নের সোনার বাংলা নতুন করে সাজানো। একটি স্বপ্নের বাগান তৈরি করা যেখানে, ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, স্বজনপ্রীতি দুর্নীতি থাকবে না। মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করবে। দুবেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারবে।
তিনি দেশে এসেই নিজেকে আত্মনিয়োগ করলেন দেশ পুনর্গঠনে। কিন্তু যুদ্ধবিধস্ত দেশ। চারিদিকে শুধু নাই আর নাই। কৃষি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। কোথা থেকে শুরু করবেন? তিনি প্রথমে হাত দিলেন কৃষি, অবকাঠামো ও শিক্ষার উন্নয়নে। বন্ধু দেশগুলোর কাছে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানান।
দেশ পুনর্গঠনের সময় যে বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল শিক্ষা। পাকিস্তান আমলে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল, উর্দু, ফারসি এবং আরবি শিক্ষা। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বেশি থাকলেও বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীনতা ছিল দৃশ্যমান। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সে থেকে, বঙ্গবন্ধু প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠনের গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। ধ্বংসস্তুপের মাঝে তাঁর সাহসী পদক্ষেপে সমস্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারিকরণ হলো। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ইতিহাসের বর্বরোচিত সে হত্যাকাণ্ডে সমস্ত পদক্ষেপে জাতি পিছিয়ে গেল।
অথচ মানসম্মত শিক্ষা আজও সূদূর প্রসারী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এর আমূল পরিবর্তন আসলেও নানা চ্যালেঞ্জে আজও ঘোরপাক খাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। একজন শিক্ষক হিসাবে চ্যালেঞ্জ দূরীকরণে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করছি-
(১) শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে, শিশু শিক্ষার বৈষম্য শূন্যের কেঠায় নামিয়ে আনতে হবে। গবেষণাহীন প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্ক্ষিত অর্জন আসতে পারে না। তাই প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
(২) নিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন করা জরুরি। মেধাবীদের তরুণদের প্রাথমিক শিক্ষায় ধরে রাখার জন্য সম্মানজনক বেতন কাঠামো প্রদান করা হোক। এছাড়ও স্বতন্ত্র প্রাথমিকে শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করতে হবে।
(৩) মেধাবীদের নিয়োগ প্রদানের মাধ্যমে ভবিষ্যতের মেধাসম্পন্ন নাগরিক তৈরির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
(৪) শিক্ষক ছাত্রের অনুপাত অবশ্যই কমাতে হবে। শিক্ষক সংকট দূরীকরণে প্যানেলসব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন।
(৫) সকল শিশুর জন্য অভিন্ন কর্মঘণ্টা বই ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করতে হবে।
পরিশেষে জাতীর জনকের ৪৫তম জাতীয় শোক দিবসে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের চাওয়া বৈষম্যহীন প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করে বন্ধবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলো। বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার শান্তি, এ হোক মজিববর্ষের জাতীয় শোক দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক : মো. বিল্লাল হোসেন, যুগ্ম সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]