ভালো বেতন দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন।
তিনি বলেন, ভালো বেতন দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার প্রজেক্ট নেই, অথচ প্রজেক্ট বানিয়েছে ছেলেমেয়েদের স্মার্টফোন ও ল্যাপটপমুখী করার।
শনিবার (৩ মে) নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে তিনি এ কথা বলেন।
অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন বলেন, শুনলাম আগামী বাজেটে নাকি শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হবে। সর্বোচ্চতো আগেও দেওয়া হতো। মূল কথা হলো সেই সর্বোচ্চটা জিডিপির কত শতাংশ? শিক্ষায় বরাদ্দ মাপার সবচেয়ে ভালো ইয়ার্ডস্টিক হলো জিডিপি। ইউনেস্কো বলছে শিক্ষায় একটি দেশের উচিত তার জিডিপির কম পক্ষে ৬ শতাংশ বা তার বেশি দেওয়া হয়। গত আওয়ামী লীগ সরকার তার শেষ বাজেটে বরাদ্দ দিয়েছিল ১ দশমিক ৬৯ শতাংশ! তারপরেও আওয়ামী দলান্ধরা সেই সরকারকে শিক্ষাবান্ধব বলে বলে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে ফেলতো।
আরো পড়ুন: মেধার মূল্যায়নে দল-মত-ধর্ম টানা অনুচিত
তিনি বলেন, যিনি বলেছেন যে এইবার শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দিবেন তিনি সেই অতিরিক্ত বরাদ্দ কি কি খাতে খরচ করবেন শুনে আমার মাথায় পানি ফুটার মত পাগ উঠেছে। তিনি বলেছেন সর্বোচ্চ বরাদ্দের টাকা শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য আমরা বেশ কয়েকটি প্রকল্পের আওতায় কাজ শুরু করেছি। নতুন নতুন ভবন নির্মাণ, আধুনিক ল্যাবরেটরি ও কম্পিউটার ল্যাবরেটরির কাজ হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এক বা একাধিক মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম চালু করার কাজে ব্যয় হবে। উনারা কি কসমেটিক প্রজেক্ট ছাড়া আর কিছু চিনেন না? সব কিছুর আগে দরকার হলো ভালো শিক্ষক নিয়োগের মেগা প্রজেক্ট নেওয়া যাতে শিক্ষকতা পেশাটা আকর্ষণীয় হয়। যদি সেটা করা হয় তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আমরা ভালো মানের শিক্ষক পেতে শুরু করব। ভালো শিক্ষক নিয়োগের আগে যত কারিগরিই করেন না কেন যোগফল প্রায় শূন্যই হবে।
তিনি আরও বলেন, শুধু তাই না আরেকটি সংবাদ শিরোনাম আমার মাথায় পাগ উঠাচ্ছে সেটা হলো ‘স্মার্ট টিভি-ল্যাপটপ পাচ্ছে প্রাক-প্রাথমিকের ১৫০০ বিদ্যালয়’। এই যে ধান্দাবাজির আবার আরেকটা স্মার্ট প্রজেক্ট। যেন আমাদের প্রাথমিক স্কুলের এটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। ভালো বেতন দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করার প্রজেক্ট নেই অথচ প্রজেক্ট বানিয়েছে ছেলেমেয়েদের স্মার্টফোন ও ল্যাপটপমুখী করার। অর্থাৎ ছোট ছোট বাচ্চাদের এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরও বেশি করে স্ক্রিনমুখী করার প্রজেক্ট। অথচ উচ্চমানের শিক্ষক দেওয়া যারা প্রত্যেকটি বাচ্চাকে বুঝতে পারবে, প্রত্যেকটি বাচ্চা যে আলাদা সেটা বুঝবে এবং বুঝে সেই অনুসারে কিভাবে এদেরকে আলাদার মাঝেও হারমোনি আনা সেই জন্য কাজ করতে পারবে। ছোট ছোট বাচ্চাদের মাঝে কমিউনিটি ফিলিং তৈরি করা, এম্প্যাথি তৈরি করা, নিয়মানুবর্তিতা তৈরি করা জরুরি। স্মার্ট টিভি ও ল্যাপটপ চালানোর মত শিক্ষক দিবেনতো? আমরা স্কুলে আইসিটি খুলেছি কিন্তু আইসিটির শিক্ষক দেইনি। এই বয়সী বাচ্চাদের শিক্ষা হওয়া উচিত সামাজিক স্কিল বাড়ানো অর্থাৎ social interaction কেন্দ্রিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক বলেন, এইসব প্রজেক্ট কেন্দ্রিক শিক্ষা থেকে আমরা কবে মুক্তি পাব? আমাদের সবার আগে দরকার ছিল একটা শিক্ষা কমিশনের। যার মাধ্যমে আমরা আগে শিক্ষার একটি যুগোপযোগী দর্শন ঠিক করা। তারপর সেই আলোকে কাজ করা। তা না করে এডহক বেসিস আজকে এই প্রজেক্ট আবার কালকে আরেকটি প্রজেক্ট দিয়ে কি দেশের শিক্ষার সার্বিক উন্নয়ন হবে? কখনো না। দরকার একটা শিক্ষা কমিশন। যেই কমিশন শিক্ষার দর্শন ঠিক করবে।
অধ্যাপক মামুন বলেন, শিক্ষকদের দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন বেতন এবং তার চেয়েও বেশি অপমান দিয়ে স্মার্ট টিভি, ল্যাপটপ, কারিকুলাম, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির যত প্রজেক্টই নেন না কেন কোন লাভ হবে না। শিক্ষকদের এমন বেতন আর সম্মান দিয়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট কারিকুলাম আর সর্বশ্রেষ্ট ক্লাসরুম দিলেও কোন লাভ হবে না। বরং শিক্ষকদের নৈতিকতা আরও বৃদ্ধি পাবে যা দেখে ছাত্ররাও শিখবে। ইতিমধ্যে এর ইফেক্ট এপিডেমিক আকার ধারণ করে ফেলেছে।