ইংরেজি শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয় - দৈনিকশিক্ষা

ইংরেজি শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়

মাছুম বিল্লাহ |

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বলা হয়, স্কুল ও কলেজে ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস ইংরেজিতেই পরিচালনা করতে হবে। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দেশপ্রেমিক ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য নৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে বলা হয়েছে।

দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ইংরেজি বিষয়ের ক্লাস ইংরেজিতে পরিচালনা করা হয় না। তাই মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ১৭ অক্টোবর ২০১৭ এ আদেশ জারি করে। এ আদেশের পক্ষে ও বিপক্ষে পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন শিক্ষক বিভিন্নভাবে মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে এ লেখা।
একজন শিক্ষক মন্তব্য করেছেন, ‘অত্যন্ত সুন্দর ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত, তবে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগে যাঁরা ইংরেজি বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁদের ইংরেজি ভাষার ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে যেসব শিক্ষক নিজেদের ইংরেজির শিক্ষক বলে দাবি করেন, তাঁদের ৯০ শতাংশ ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন না অথচ তাঁরা একেকজন গ্রামারের জাহাজ। আরে ভাই, এই পৃথিবীতে ভাষার জন্ম আগে, না গ্রামারের জন্ম আগে? অবশ্যই ভাষা। তাই আসুন, আমরা যাঁরা ইংরেজির শিক্ষক আগে আমরা ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করি। আমাদের সীমাবদ্ধতার জন্য কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কেন ভুগবে?’ চমৎকার ও বাস্তবমুখী মন্তব্য।

তবে এটিও খেয়াল রাখতে হবে যে সব শিক্ষককে একসঙ্গে ইংরেজিতে প্রশিক্ষণ করানো সম্ভব নয়। সবাইকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিষয়টি চালু করতে বহু বছর সময় লেগে যাবে। ফলে আমরা পিছিয়ে পড়ব বহু বছর। ইংরেজির অনেক শিক্ষক প্রতিবছর অবসরে যান, আবার নতুন অনেক শিক্ষক শিক্ষকতায় যোগদান করেন। কাজেই একবার বা দুইবার প্রশিক্ষণ দিয়ে সবার কাছে যাওয়া যাবে না। তা ছাড়া ইংরেজির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কিন্তু সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন মেয়াদে চলছে। তবে এ প্রশিক্ষণ কতটা কাজে লাগছে শিক্ষকদের এবং শিক্ষকরা তা শ্রেণিকক্ষে কতটা ব্যবহার করতে পারছেন সেটি একটি প্রশ্ন। কারণ বিষয়টি ঠিকভাবে মনিটরিং হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ইংরেজির শিক্ষকদেরই এগিয়ে আসতে হবে। এই শিক্ষক চমৎকারভাবেই বলেছেন যে আমাদের অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষক একেকজন গ্রামারের জাহাজ, তাঁরা শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা অর্জন করানোর চেয়ে গ্রামার শেখানোকেই ইংরেজি পড়ানো বলে মনে করেন। আসলে ভাষা ব্যবহার কিভাবে করতে হবে সেটি আমরা শ্রেণিকক্ষ কিংবা শ্রেণিকক্ষের বাইরে কোথাও কার্যকরীভাবে ব্যবহার করা শেখাই না, শুধু গ্রামারের নিয়ম-কানুন মুখস্থ করাই। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষা বাস্তবজীবনে ব্যবহার করতে পারছে না; যদিও তারা খুব ভালোভাবেই সেটি করতে পারত।

‘বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষকের বদলে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক ইংরেজি ক্লাস নেন। এ ক্ষেত্রে পেট ও লিভারের ডাক্তার দ্বারা যেমন বক্ষব্যাধির চিকিৎসা সম্ভব নয়, তেমনি অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে ইংরেজি ক্লাস ইংরেজিতে নেওয়া সম্ভব হলেও ফলপ্রসূ হবে না। ’ এই শিক্ষকও বাস্তবে যা ঘটে তা-ই তুলে ধরেছেন। তবে এটি আমাদের দেশের বাস্তবতা যে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই। ইংরেজির শিক্ষক ইংরেজিসহ বাংলাও পড়ান, আবার সমাজবিজ্ঞান, এমনকি কমার্সের শিক্ষকরাও ইংরেজি পড়িয়ে থাকেন। এটি আমাদের দেশের বাস্তবতা। ২০ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কাজেই সর্বত্র বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভবও নয়।

‘ইংরেজি ক্লাস ইংরেজিতে নিতে গেলে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক সহজে ক্লাস নিতে পারবেন না। তাঁরাই পারবেন যাঁরা ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স। জেলা-উপজেলায় অনেক পাস কোর্সের শিক্ষক আছেন, তাঁরা ইংরেজি ক্লাস ইংরেজিতে নিতে পারবেন না। ফলে এ আইনটি কয়েকজন শিক্ষকের জন্য প্রযোজ্য হবে। ’…এটিও একজন শিক্ষকের মন্তব্য। আরেকজন শিক্ষকের মন্তব্য, ‘এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কয়জন ইংরেজির শিক্ষক আছেন, বেশির ভাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইংরেজির শিক্ষক নেই। যাঁরা ইংরেজি ক্লাস নেন তাঁরা একই সঙ্গে বাংলা ক্লাস নেন, আবার ইংরেজি ক্লাসও নেন। তা ছাড়া ইংরেজির শিক্ষকদের মধ্যে কয়জন ইংরেজিতে সঠিকভাবে কথা বলতে পারেন তা আগে ভাবতে হবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের উচিত সঠিকভাবে ইংরেজি জানেন এমন শিক্ষকদের ইংরেজি ক্লাসের দায়িত্ব দেওয়া। তবে মূল সমস্যা হচ্ছে, গ্রামের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ইংরেজি বোঝে না। তাই প্রাইমারি স্কুলে এটি চালু করতে হবে। ’ ইংরেজিতে যাঁরা অনার্স-মাস্টার্স করেন তাঁরাই যে শুধু ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, বাকিরা পারেন না, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। ইংরেজিতে যাঁরা অনার্স-মাস্টার্স করেছেন, তাঁদের ইংরেজি চর্চা বা ইংরেজি পড়া একটু বেশি থাকে। তাই বলে অন্য বিষয়ের শিক্ষকরা যে ইংরেজি পারবেন না, তা নয়। এখানে উল্লেখ্য যে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি মাধ্যমিক শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে থাকে। সেখানে শিক্ষকদের মধ্যে থেকেই এক দল প্রশিক্ষকও তৈরি করা হয়েছে। তাতে দেখা যায় যে অন্য বিষয়ের শিক্ষকরাও যাঁরা ইংরেজি পড়ান, তাঁদের দক্ষতা কোনো অংশে কম নয় এবং অনেকেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ইংরেজিতে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছেন। ইংরেজি একটি ভাষা, এটি প্র্যাকটিস করলে এবং আগ্রহ থাকলে অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন, ইংরেজিতে ক্লাস নিতে পারেন। আর শিক্ষার্থীরা ইংরেজি বোঝে না, এটাই তো স্বাভাবিক। তাদের মাতৃভাষা বাংলা, তারা সব সময়ই বাংলা শুনছে। কাজেই ইংরেজি তাদের না বোঝারই কথা। তারা যেভাবে বোঝে সেভাবে আস্তে আস্তে এগোতে হবে। ক্লাসে ইংরেজি না বললে তারা শিখবে কিভাবে?

‘আমার মনে হয় আগে জরিপ করে দেখা দরকার এ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইংরেজির শিক্ষক আছে কি না। আমার জানামতে নেই। তাহলে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করবে কে? কোনো আদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে তার উপকরণ থাকতে হবে। তাই আগে শিক্ষক দিয়ে তারপর আদেশ দেওয়া উচিত। সমস্যার গোড়া চিহ্নিত করে সমাধানের উদ্যোগ নিলে তবেই সফলতা আশা করা যায়। ’ এক শিক্ষকের মন্তব্য। এটি অবশ্য একটি কাজের কথা। জরিপ করে একটি প্রতিবেদন জাতির সামনে পেশ করা দরকার। এখন ইংরেজিতে অনার্স অনেক কলেজেই পড়াচ্ছে। এসব কলেজ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে শিক্ষকতায় প্রবেশ করছেন। অবস্থা ভবিষ্যতে ভালোর দিকে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস, তবে সঠিক একটি জরিপ প্রয়োজন।

আরো একজন শিক্ষক বলেছেন, ‘অবশেষে সরকারকে নির্দেশ দিতে হলো যে ইংরেজি ক্লাস অবশ্যই ইংরেজিতে নিতে হবে। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত ভালো সিদ্ধান্ত। ইংরেজি শিক্ষার নামে এত দিনে যা শেখানো হতো, তা হলো শুধু পরীক্ষায় পাস। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে ইংরেজি শেখানোর উদ্দেশ্য হচ্ছে ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতা শেখানো। অর্থাৎ স্পিকিং, লিসেনিং, রিডিং ও রাইটিং দক্ষতা শেখানো। ক্লাসে ইংরেজি বলা ও শোনানো ছাড়া ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ দক্ষতা শেখানো মোটেই সম্ভব নয়; যদিও ২০০৭ সাল থেকেই সরকার টিকিউআই প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল সিএলটি ব্যবহার করে ক্লাস নিতে। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষকই তা করতেন না। সরকার শিক্ষকদের পরামর্শ অনুযায়ী লিসেনিং ও স্পিকিং পরীক্ষা চালু করার নির্দেশ দিলেও প্রায় কোনো স্কুলেই লিসেনিং ও স্পিকিং পরীক্ষা নেওয়া হয় না। আশা করা যাচ্ছে এ নির্দেশনার পর ইংরেজি শিক্ষার ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কিন্তু মনিটরিং ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। অন্যথায় এসব শুধু কাগজে-কলমেই থাকবে। ’…এ শিক্ষক সার কথাটিই বলেছেন।

আমি একজন শিক্ষক হিসেবে পুরো শিক্ষকসমাজকে অনুরোধ করব, যে যা-ই বলুক না কেন, আমাদের পেশাগত উন্নয়নের কথা আমাদের নিজেদেরই ভাবতে হবে। ইংরেজিতে ক্লাস নেওয়া মানে ইংরেজিতে ভোকাবুলারি একেবারে রিচ (উন্নত) হতে হবে, গ্রামারের সব স্ট্রাকচার ঠিকভাবে জানার পর কথা বলা শুরু করতে হবে, তা কিন্তু নয়। আপনি সহজ সহজ ইংরেজি দিয়ে শুরু করুন। ইংলিশ ফর টুডেতে কিন্তু শিক্ষকদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে। সেটি দিয়েই শুরু করুন। কয়েক দিন করার পর আপনার কনফিডেন্স লেভেল বেড়ে যাবে। তখন নিজেই শ্রেণিকক্ষে ইংরেজি বলতে উৎসাহ বোধ করবেন। আপনার ইংরেজি ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলেও ইংরেজিতে ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিন। এটি আপনার নিজের জন্যই মঙ্গল নিয়ে আসবে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি - dainik shiksha পরীক্ষার আগেই হবু শিক্ষকদের হাতে পৌঁছে যায় উত্তরপত্র: ডিবি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032298564910889