নৈতিক শিক্ষা ও আইনের বেড়াজাল - দৈনিকশিক্ষা

নৈতিক শিক্ষা ও আইনের বেড়াজাল

মো. নজরুল ইসলাম |

সচেতন একজন নাগরিকের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে যখন প্রতিদিনের দৈনিক খবরের কাগজে অথবা অন্য কোনো মাধ্যমে তার চোখে পড়ে তারই প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলার সোনার সন্তানদের অপকর্ম ও দুর্নীতির লম্বা খতিয়ান। এদেশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, ব্যবসায়ীদের দুর্নীতি, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। কারণ, দুর্নীতিই এখন অনেকের চরিত্রের মূলনীতি। কিন্তু এই তালিকায় যখন কোনো শিক্ষকের নাম যুক্ত হয় অথবা, ধর্মীয় লেবাসধারী কাওকে এই তালিকার শীর্ষে দেখা যায় তখন শুধু শ্বাসরুদ্ধ নয় একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সাধারণ মানুষ তবে কার প্রতি আস্থা রাখবে, কার ওপর ভরসা করবে? প্রশ্ন জাগে, কেনো এমনটি হচ্ছে?

একজন সাধারণ শিক্ষায় অথবা ধর্মীয় শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত, দেখে মনে হয় আপাদমস্তক ভদ্রলোক, তার চরিত্রের এই স্খলন কেনো? নিশ্চয় তার শিক্ষায় কোথাও একটা শুন্যতা (Vacuum) রয়েছে, পরিপূর্ণতা বা পূর্ণাঙ্গতা পায়নি। হ্যাঁ, ওই  শূন্য জায়গাটি যা দিয়ে পূরণ হবার কথা ছিলো তার নাম ‘নৈতিক শিক্ষা’ যেটি আসে প্রধানত নিজ পরিবার থেকে, মা-বাবার কাছ থেকে, অতঃপর শিক্ষকদের কাছ থেকে। এই ঘাটতির কারণেই পদমর্যাদা, সামাজিক মর্যাদা ও আত্মসম্মান বিস্মৃত হয়ে বেশকিছু সচেতন নাগরিক সচেতনতা হারিয়ে, বোধশক্তি থাকা সত্বেও অচেতন হয়ে, পার্থিব মোহগ্রস্ত হয়ে নানাবিধ অপকর্ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। প্রথমে সীমিত আকারে, এরপর সীমা ছাড়িয়ে, একেবারে নেশাগ্রস্তের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে অনৈতিক কাজে, আর তখনই কোনো না কোনোভাবে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে তার অপকর্মের ইতিহাস, ধরা পড়ছে প্রসাশনের কাছে। প্রবাদ আছে ধর্মের ঢোল আপনি বাজে-হয়ত ধৃতজনদের পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে তাই তাদের অপকর্মের বিষয়টি আর গোপন থাকেনি। এরপর খুব স্বাভাবিকভাবেই আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়, এখনো যারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে তাদের সংখ্যা নিশ্চয় আরো অনেক বেশি। 

মানব-শরীরে ক্যানসারের জীবাণু প্রাথমিক অবস্থাতে খুব কমই ধরা পড়ে, লক্ষণ যখন বাহ্যিকভাবে প্রকাশ পায় তখনই ডায়াগনোসিসের মাধ্যমে বোঝা যায় শরীরের অভ্যন্তরে আসলে ক্যানসার নামক প্রাণঘাতী জীবাণু বাসা বেধেছে। সমাজের ক্যানসার তাৎক্ষণিক ডায়াগনোসিসের কোনো শক্তিশালী যন্ত্র বা প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত না হওয়ায় এই সামাজিক ব্যামোটি ধরা পড়তে অনেক সময় ব্যয় হয় বা আদৌ কখনো ধরা পড়ে না। আবার অফিস-আদালতে ব্যক্তি বিশেষের মধ্যে এই রোগের বিশেষ লক্ষণ প্রকাশ পেলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না, পাছে আবার প্রকাশকারীর ওপর কী বিপদই না নেমে আসে, উল্টো তার মাথার ওপরেই বিপদের খাঁড়া নেমে আসে কি না, তার নিজের চাকরি নিয়েই টানাটানি বেধে যায় কি না-এসবের ভয়ে।  

আজকাল রাজনীতি, ব্যবসা, চাকরি-সব জায়গাতেই সিন্ডিকেট নামক একটি অদৃশ্য শক্তি ক্ষমতার বলয় সাংঘাতিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে আছে। এই সিন্ডিকেটের হাত অনেক লম্বা, ক্ষমতা সীমা থেকে অসীমের দিকে অগ্রসরমান। সব সিণ্ডিকেটের হোতা থাকেন একজন। তিনি সে রকমের হোমরাচোমরা, যার দাপটে অন্যেরা কম্পিত, ভীত-সন্ত্রস্ত। যখনো কোথাও দুর্নীতির এই স্বর্ণখনি আবিষ্কৃত হয় তখনই দেখা যায় সে খনির সর্বনিম্নে সবার অগোচরে প্রায় অবস্থান করে দ্বিপদী এক হীরকখণ্ড যাকে স্পর্শ করা দুঃসাধ্য একটি কর্ম বটে। এই হীরকখণ্ডকে আইন-আদালত খুব সহজেই স্পর্শ করতে পারে না। আইনের জালে অনেক বড় বড় ছিদ্র থাকায় তিনি সেই ছিদ্রপথ দিয়ে বেরিয়ে যান। হয়তো দু’একটা চুনোপুঁটি সে জালে আটকা পড়ে আইনের মারপ্যাঁচে কিছুদিন আঁকুপাঁকু করে। তারপর নিজ পরিবারকে অথৈ জলে নিক্ষেপ করে জেলের ঘানি টানতে থাকে। 

দুদক নামক নামক একটি দন্তহীন বুড়ো ব্যাঘ্র এদেশে আছে বটে তবে সে ব্যাঘ্রটিও রুই-কাতলা শিকারে অপারগ। দু’একটি পোনা শিকারেই তাকে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। ইদানিং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে অনেক খবরই আমজনতার গোচরে আসে, সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের বিদেশে অর্থপাচার, ব্যাংক লুট, জালিয়াতির খবর এখন আর কারো অজানা নয়। সাম্প্রতিককালে, প্রায় মাসখানেক ধরে ধারাবাহিকভাবে ইউটিউবে প্রচারিত হচ্ছে একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তার অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার রহস্য উদঘাটনের খবর। টিভি টক শো তে দুদকের একজন আইনজীবীকে অসংখ্য প্রশ্নবাণে ঘর্মাক্ত হতে দেখা গেলো ক’দিন আগে। তিনি অবশ্য সবগুলো মামলাই তদন্তাধীন রয়েছে, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাব, লজিস্টিক সাপোর্টের অপ্রতুলতা, ইত্যাদি বলে নিজেকে দায়মুক্ত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। 

অনেক তদন্তই যে আলোর মুখ দেখবে না, হালে পানি পাবে না, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে অনেকেই এখন তা প্রায় জোর দিয়েই বলতে পারেন। কারণ, ওই একটাই-আইনের ফাঁক। আইন নামক জালটির ফুটো আগেই থেকেই ছিলো, এখনো আছে, তবে সে ফুটোর আয়তন-পরিধি প্রসারিত হচ্ছে ক্রমেই। লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এবং তদন্ত ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় সাধারণ মানুষ এখন উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এবং হতাশ। 

এ সপ্তাহের টক অব দ্য টাউন ছিলো কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের অবৈধ সনদ কেনাবেচার জমজমাট ব্যবসা নিয়ে। সুখের খবর, শেষ পর্যন্ত ডিবি’র জালে আটকা পড়েছেন নাটকের কুশীলবরা। প্রাথমিকভাবে ওই শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম অ্যানালিস্টকে আটক করা হলেও তার কবুলনামা থেকে জানা যায় শিক্ষা বোর্ড নামক এ প্রতিষ্ঠানের নায়কই নেপথ্যে খল নায়কের ভূমিকায় রয়েছেন। বোর্ডের সম্মানিত চেয়ারম্যান একজন প্রফেসর, মহান শিক্ষক, যিনি টাকার লোভে তার স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে এই জঘন্য কারবারের নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে খবরে প্রকাশ। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ হবার পরই চূড়ান্ত সত্যটি জানা যাবে। সরকারি কলেজের একজন প্রফেসরের কি সত্যি টাকার অভাব? কীভাবে পারলেন তিনি এতো নিচে নামতে? আবার বাইরে তিনি ধর্মীয় লেবাসে, নূরানি চেহারায় আত্মপ্রকাশিত যাকে দেখে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করবার কোনো উপায় নেই। বিক্রিত সনদ্গুলো যথারীতি বোর্ডের ওয়েবসাইটেও আপলোড করা হয়েছে এবং সিস্টেম অ্যানালিস্ট কাজটি এতো দক্ষতার সঙ্গে ও সূক্ষ্মভাবে করেছেন। সেসব সনদ জাল বলে আপাতত প্রমাণেরও তেমন কোনো সুযোগ নেই বিধায় ভবিষ্যতে ধরা পড়বার ভয়ও নেই। 

উল্লেখ্য, এসব সনদের বদৌলতে ইতোমধ্যেই অনেকে চাকরি পেয়েছেন, অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হয়েছেন। এসব ভুয়া সনদধারীরা পরবর্তীতে তাদের কর্মক্ষেত্রে তথা দেশের প্রতি কী অবদান রাখতে সক্ষম হবেন তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু কোথা থেকে কী যেনো হয়ে গেলো, বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়ে গেলো। হঠাৎ করেই যেনো এ বছর  নিয়তি নাখোশ। কয়েক বছর ধরে মহানন্দে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পর এ চক্রটি এবার হোঁচট খেয়ে একেবারে ধরাশায়ী হয়ে পড়লো। এখন দেখার পালা তাদেরকে কীভাবে আইনের আওতায় আনা হয়। জাতি উন্মুখ হয়ে আছে যারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করবার এমন হীন কাজে লিপ্ত ছিলেন দিনের পর দিন তাদের কী শাস্তি হয় তা দেখার জন্য। আদৌ কী তারা শাস্তি পাবে, নাকি সেই সুপরিচিত আইনের ছিদ্র দিয়ে ছাড়া পেয়ে আবার পূর্বের ব্যবসায় নতুন উদ্যমে আত্মনিয়োগ করবেন। গ্লাডস্টোন বলেছিলেন, ‘Justice delayed, justice denied’। এ ক্ষেত্রে বিচারের রায় প্রদানে যেনো অযথাই সময় ক্ষেপণ করা না হয় সেটাই একান্তভাবে কাম্য ।   

লেখক: যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়                 

 

ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি - dainik shiksha আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0094230175018311