দেশে প্রথমবারের মতো সরকারিভাবে ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপিত হতে যাচ্ছে জেনে দূর প্রবাস থেকে সত্যি এক অন্য রকম আনন্দ অনুভব করছি। ২৭ অক্টোবর ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপন করায় সরকারের সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। এই সঙ্গে দেশের শিক্ষক সমাজ, বিশেষ করে 'বেসরকারি' বলে খ্যাত ছয় লক্ষাধিক এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে আজকের লেখাটি শুরু করতে চাই।
বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের জন্য নিঃসন্দেহে এটি আনন্দের বিষয় যে, সরকার ২৭ অক্টোবর ‘শিক্ষক দিবস’ উদযাপন করছে। দেশের সকল স্তরের শিক্ষকেরা এটিকে ইতিবাচক দেখছেন। দিবসটি যথাযোগ্যভাবে পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে শিক্ষকেরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষক সম্প্রদায় সরকারের এ সিদ্ধান্তকে যুগোপযোগি মনে করে নানা স্বপ্নের বীজ আবার নতুন করে বুনতে শুরু করেছেন। দিবসের প্রতিবাদ্য বিষয়টি শিক্ষক সমাজকে আরও বেশি আশাবাদী করে তুলেছে। 'শিক্ষকদের হাতে শিক্ষার রুপান্তর শুরু'-এই শাশ্বত চিরন্তন সত্য কথাটি শিক্ষক দিবসে ফুটে উঠায় শিক্ষকের গুরুত্ব ও মর্যাদা নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার রাষ্ট্রীয় প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়েছে।
এতদিন দেশে কেবল কাব্য-কবিতায় এবং বক্তৃতা-বিবৃতিতে শিক্ষকের মর্যাদা প্রত্যক্ষ করেছি। বাস্তবে শিক্ষকেরা বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকেরা সর্বাধিক অবহেলিত একটি সম্প্রদায়। আমলাতন্ত্রের কাছে শিক্ষকেরা খুবই তুচ্ছ। একান্ত নগন্য। এরা শিক্ষকদের কতটুকু মনে প্রাণে সম্মান করে-সেটি আমার কাছে বিরাট এক প্রশ্ন। নানা অবহেলা ও বঞ্চনায় তাদের দিনাতিপাত। মোটামুটি খেয়ে পরে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকার গ্যারান্টিটুকু বেসরকারি শিক্ষকদের নেই। এই প্রেক্ষাপটে শিক্ষক দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত সত্যি এক আনন্দের বিষয়। দিবসটি অন্তত বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য অনেক আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
এরপরও 'শিক্ষক দিবস'-এর ওপর আমলাদের কুনজর ছিল বলে আমার কেন জানি মনে হয়েছে। তা না হলে এটি শুধু ‘শিক্ষক দিবস’ না হয়ে 'জাতীয় শিক্ষক দিবস' হতে পারতো। অথবা, অন্যান্য দেশের মতো ৫ অক্টোবরকে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালন করা যেতো। আমরা দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে দেখতে চাই। তাহলে দিনটি অন্য এক মর্যাদা লাভ করবে এবং দেশ থেকে শিক্ষা ও শিক্ষকের দূর্দশা অনেকাংশে দূর হবে। 'শিক্ষক দিবসে' সারাদেশে সর্বস্তরের শিক্ষকেরা মিলে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করবেন। সভা, সেমিনার হবে। সরকারিভাবেও সভা-সেমিনার আয়োজন করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে দিবসটি পালনের জন্য উদযাপন কমিটির রূপরেখা দেয়া হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রণালয়ের এই প্রয়াসকে প্রশংসনীয় উদ্যোগ হিসেবেই দেখতে হয়।
শিক্ষক দিবসে সশরীরে অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকলেও সুদুর প্রবাস থেকে এই আনন্দ-উচ্ছাসের মুহূর্তে শিক্ষক সমাজের দু'চারটি দাবি জানিয়ে আজকের লেখাটি এখানে শেষ করতে চাই। সব স্তরের শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দেয়া উচিত। শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি বৈষম্যের অবসান হওয়া দরকার। এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রধান ও সহকারী প্রধানদের সময়ান্তে দু'টি করে উচ্চতর স্কেল প্রদান করা সময়ের দাবি। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর গ্রহণের তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের সমুদয় টাকা বুঝিয়ে দিন। বদলি ব্যবস্থা চালু করে বিধিমত বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা প্রদানের বিহিত ব্যবস্থা নিন। আর তাহলেই 'শিক্ষক দিবস' উদযাপন যথার্থ ও সার্থক হবে। অন্যথায় সবই ভুয়া। কেবলি ধোঁকাবাজি। শিক্ষক সমাজের সাথে প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার আবাসিক সম্পাদক । লন্ডনে বসবাসরত।