অনিয়ম-দুর্নীতি সবই যেখানে উন্মুক্ত - দৈনিকশিক্ষা

অনিয়ম-দুর্নীতি সবই যেখানে উন্মুক্ত

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ |

ঝরে পড়া ও পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কথা চিন্তা করে সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় নামের প্রতিষ্ঠান। উন্মুক্তভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্য নিয়েই এর এগোনোর কথা। তবে এখানে শুধু শিক্ষা নয়, সবই হচ্ছে উন্মুক্তভাবে। এমনকি বাদ নেই অনিয়ম-দুর্নীতি। এখানে অনিয়ম-দুর্নীতি পুরোপুরি উন্মুক্ত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি) ভর্তি থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ, কিংবা সনদ উত্তোলন— এর প্রতিটি পদে হয়রানির শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ফরম পূরণে ভুল তথ্যে পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকতে হয় তাদের। সংশোধন করতেও তাদের হতে হচ্ছে নানা হয়রানির শিকার। সনদে নাম, জন্মতারিখ, বাবার নামসহ নানা ভুল তথ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের করা হয় হয়রানি। পাঠ্যবই পেতে তাদের গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। পরীক্ষার রুটিন দেওয়ার পরও মেলে না পাঠ্যবই। ভর্তি হতে খরচ করতে হয় সাধারণ ফির অতিরিক্ত টাকা। আর এসব অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের  যাবতীয় কার্যক্রম। এখানকার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী আর প্রশাসনের মধ্যে কোনো সমন্বয় ও সমঝোতা নেই বললেই চলে। তারা চলছেন যে যার মতোই ফ্রি স্টাইলে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী সপ্তাহের পর সপ্তাহ অফিস করেন না। আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোর সঙ্গেও যোগাযোগ সক্রিয় নয়। অনিয়মের কমতি নেই আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোতেও।

ফলে বাউবির শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সময়মতো পরীক্ষা না হওয়া ও ফল প্রকাশে বিলম্ব। সব মিলিয়ে বাউবিতে অনিয়ম-দুর্নীতির সবই এখন ওপেন। কর্মকর্তাদের অভিযোগ, বিগত সময়ে শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা হয়েছিল বলেই প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি। সেশনজটের কারণে কমে গেছে শিক্ষার মান। এখানে পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষা খাতে সরকারের শতভাগ সফলতা থাকলেও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ এবং শিক্ষার মান বাড়ানো নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ মান্নান  বললেন, ‘বাউবিকে ডিজিটালাইজ করতে সব কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। একসময় অনিয়ম থাকলেও এখন তা অনেকটা কমে এসেছে। ’ সরেজমিন বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, একটু বৃষ্টিতেই মূল ফটকের সামনে হাঁটুপানি জমে প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ভিতরেও এক অবস্থা।

পানিতে একাকার। অফিস ভবনের ভিতরও পানি জমে তৈরি হয়েছে নোংরা পরিবেশ। প্রতিদিন সকাল থেকে এখানে ভিড় করেন বিভিন্ন কোর্সের শিক্ষার্থীরা। সনদে নাম, বাবার নাম, জন্মতারিখসহ বিভিন্ন তথ্যে ভুল সংশোধন করতে এসেছেন অনেকে। তবে এখানেও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে তাদের। সময়মতো পাচ্ছেন না সংশোধনের সুবিধা। গাজীপুরে বাউবির প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় পাবনা থেকে আসা শিক্ষার্থী বিপ্লব কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি পাবনা বিবি পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু সমস্যা তার জন্মতারিখে ভুল। বিপ্লব বলেন, ‘জন্মতারিখ সংশোধন করতে আঞ্চলিক কেন্দ্রে বহুবার গিয়েও কোনো সমাধান না পেয়ে এসেছি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে। অথচ এখানে এসেও শিকার হতে হচ্ছে নানা হয়রানির। তিন দিন ধরে ঘুরছি। অফিসের একজন বলছেন এখানে নয়, তো অন্যজন বলছেন ওখানে। সর্বশেষ জানতে পারি, সাড়ে তিন মাস পর পাব সংশোধিত সনদ। ’ মানিকগঞ্জের আরিফ এসেছেন একই সমস্যা নিয়ে।

রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে এসেছেন ইমরান। তিনিও একই সমস্যা নিয়ে এসেছেন। পাশেই স্টুডেন্ট কর্নার (পুরুষ) ও স্টুডেন্ট কর্নার (মহিলা) কক্ষে অপেক্ষা করতে দেখা গেল অর্ধশতাধিক ছাত্র-ছাত্রীকে। এদের সবারই সমস্যা প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু অপেক্ষা করতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেকে সমস্যা নিয়ে ঘুরছেন দিনের পর দিন। এদিকে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার পরও চট্টগ্রাম এলাকায় অন্তত ৩৬৬ জন শিক্ষার্থীর ফলাফল এসেছে অনুপস্থিত। ১১ বিষয়ের জায়গায় ১৪ বিষয় পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। রেজাল্টশিটে ২০১৫ সালের স্থলে ২০১৪ সালসহ রয়েছে নানা সমস্যা। ওই সব শিক্ষার্থীর মধ্যে ১২২ জন গাজীপুরে বাউবির প্রধান কার্যালয়ে অভিযোগ পাঠান। উত্তর না পেয়ে তারা প্রধান কার্যালয়ে যান। কিন্তু এর পরও কোনো অগ্রগতি নেই। শিক্ষার্থীরা জানান, বাউবির যুগ্ম-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ এস এম নোমান আলম ও সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নাজনীন নেগার শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যা সমাধানের দায়িত্বে আছেন। কিন্তু তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছেন না। তাই এ দুই কর্মকর্তার বহিষ্কার দাবি, নানা অনিয়ম ও হয়রানি রোধে অনশন করেন শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৫টি আনুষ্ঠানিক প্রোগ্রামে এ বছর পাঁচ লাখ ২১ হাজার ৬৭৬ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ আঞ্চলিক কেন্দ্র ও ১ হাজার ৬০০ স্টাডি সেন্টারে ২৪ হাজার শিক্ষক পাঠদান করছেন। অভিযোগ রয়েছে— রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহরে বাউবির যেসব আঞ্চলিক বা উপকেন্দ্র রয়েছে, এর অধিকাংশে শিক্ষা কার্যক্রম নানাভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে।

শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে এসে মাসের পর মাস ফিরে যাচ্ছেন। ক্লাস শুরু হওয়ার ছয়-সাত মাসের মাথায়ও তারা হাতে পাননি বই। এমনকি অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয়ও কমেছে। বন্ধ হয়ে গেছে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিসহ অনেক প্রোগ্রাম। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, শিক্ষাবর্ষ শুরুর নির্দিষ্ট সময়ের পরও সারা দেশের আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোয় বই পাওয়া যায় না। এক বছরের কোর্স তিন বছরেও শেষ করা যায় না। দায়িত্বশীলদের কারও সঙ্গে কারও সমন্বয় নেই। ফলে বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের শিকার হতে হয় নানা হয়রানির। এমনকি ফরম পূরণের টাকা জমা দিয়েও পরীক্ষার সময় রেজিস্ট্রেশন খাতায় নাম না থাকায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহ মহিলা ডিগ্রি কলেজ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে একাদশ শ্রেণিতে প্রথম সেমিস্টারে ভর্তি হওয়া সুমাইয়া জানান, প্রথম বর্ষে ভর্তি হতে তাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আর দ্বিতীয় সেমিস্টারে ভর্তি হয়ে পরীক্ষা দিতে পারছেন না তার ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থী। এইচএসসি পাস করা একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের গাফিলতির কারণে অনার্সে ভর্তি হতে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে তাদের। প্রতিষ্ঠানটি অনলাইনে তথ্য না দেওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়ার পরও অনেক শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীরা জানান, কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় না দীর্ঘ সময়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার এক বছর পর প্রকাশিত হলেও ওয়েবসাইটে ফল পাওয়া যায় না। অথচ নিয়ম হলো তিন মাসের মধ্যে ফল প্রকাশ করা। শিক্ষার্থী উত্তম চন্দ্র অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আমরা বছরের পর বছর ভোগান্তিতে আছি। ফল প্রকাশ নেই। পড়ালেখার মান নেই। শিক্ষার্থীদের কথা তারা শুনতে চান না। মাঝে-মধ্যে কয়েক বছর পর ফল প্রকাশ করা হলেও তা থাকে ভুলে ভরা। শুদ্ধ করতে আবেদন করার পরও আমলে নেয় না কর্তৃপক্ষ। ’ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম এ মান্নান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানটিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে আমরা কাজ শুরু করেছি। অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতি সব পরিষ্কার করে নতুনভাবেই ঘুরে দাঁড়াবে বাউবি। ’

সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053210258483887