বাংলা ভাষার শক্তি, বাংলা ভাষার শত্রু - দৈনিকশিক্ষা

বাংলা ভাষার শক্তি, বাংলা ভাষার শত্রু

গোলাম কবির |

বাহান্নর রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা, তথ্য-উপাত্ত এবং পরস্পরবিরোধী বর্ণনা কম হয়নি। দুনিয়ায় এমনটি বোধ করি নজিরবিহীন। জ্ঞাত সভ্যতার ইতিহাসে একাধিক সমৃদ্ধ ভাষার অস্তিত্ব মুখের ভাষায় টিকে নেই, তবে জীবন সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে সংরক্ষিত। হিব্রু, সংস্কৃত, পাহলবি, গ্রিক, লাতিন ইত্যাদি ভাষায় কেউ কথা বলে না; কিন্তু সেসব ভাষায় সাহিত্য দর্শন, ইতিহাস-বিজ্ঞানের অমূল্য সম্পদ আমরা নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগাই। ওই সব ভাষাভাষী মানুষ ক্ষমতার দম্ভে সম্পদের লিপ্সায় আগ্রাসী হয়েছে। শান্তিপ্রিয় বাঙালি কারো বাড়াভাতে ছাই দেয়নি, অথচ তাদের ‘মাতৃদুগ্ধসম’ মাতৃভাষা বারবার আক্রান্ত এবং নিগৃহীত হয়েছে। আবার আপন অন্তর্নিহিত শক্তি বলে জেগে উঠেছে। এ জন্য বোধ করি বাংলা ভাষার নিজের মর্যাদায় অধিষ্ঠানের সংগ্রাম জগতে অনন্য। এমন কোথাও কি আছে, মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের পথ ধরে একটি স্বাধীন দেশ ও জাতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা!

ইতিহাসের পেছনে আমরা ছুটব না, তবে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা যে রক্ত দিয়েছি, তার ঋণ কতটুকু পরিশোধ হলো, তা ফিরে দেখার চেষ্টা করব। অনস্বীকার্য যে বাংলা ভাষা আমাদের মাথা তুলে চাওয়ার শক্তি জুগিয়েছে। আমরা পশুশক্তিকে দেখিয়ে দিয়েছি মাভৃভাষার অঙ্গনে হানা দেওয়ার পরিণতি। সেসব ইতিহাসের সারবস্তু কালান্তর ধরে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও বঙ্গবন্ধু। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের সাহিত্যরসিক মানুষের কাছে উজ্জীবিত করেছেন বাংলা ভাষার মাধ্যমে হৃদয়ের কথার বাণীরূপ। নজরুল আবেগ আর শৌর্যের সমন্বয়ে ক্ষুরধার বাণী প্রকাশের দুরন্ত সাহস দেখিয়েছেন ভেদবুদ্ধির মানববিদ্বেষীদের। বঙ্গবন্ধু বিশ্বসভায় মাতৃভাষা বাংলায় ভাষণ দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন শক্তিশালী বাংলা ভাষায় প্রকৃতির সব ধ্বনি কী অবলীলায় আত্মস্থ করা যায়। আমাদের গরবের বাংলা ভাষা, একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। সুদূর পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্থান করে দিয়ে, আগ্রাসন ছাড়াই শান্তিপূর্ণ সাংস্কৃতিক বিজয়ের সূচনা হয়েছে। অথচ এই ভাষাকে ভূলুণ্ঠিত করার চক্রান্ত তার জন্মলগ্ন থেকে পঁচাত্তরের পৈশাচিক দুর্বৃত্তায়নের পরও কম হয়নি। জনৈক সাম্প্রদায়িক রাজনীতিজীবীকে বলতে শুনেছি, ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ নাকি এ অঞ্চলের মুসলমানদের সর্বনাশের আকর হয়েছে। কী ক্ষমার অযোগ্য উচ্চারণ! ওরা এটা বলেছে এবং বলবে। কারণ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান মুক্তিযুদ্ধে শত্রুবেষ্টিত দিনগুলোতে বাঙালির মনে যেমন সাহস ও শক্তি জোগাত, তেমনি পকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের সহায়ক এ দেশের আলবদর-আলশামস-রাজাকারদের হৃৎকম্পনের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির ঘাতক ও তাদের দোসররা জানত, জয় বাংলা স্লোগানের অশেষ শক্তির কথা। তাই তারা সম্প্রচারযন্ত্র দখল করে অলিখিতভাবে জয় বাংলা নিষিদ্ধ করে। খোদা হাফেজের পরিবর্তে আল্লাহ হাফেজ বলতে থাকে। এ ছিল অতি ধার্মিকতা দেখানো এবং একটি কট্টর সাম্প্রদায়িক দেশকে খুশি করার আয়োজন।

মধ্য এশিয়ার কিছু দুর্ধর্ষ শক্তিধর মানুষ একদা ভারত অধিকার করে। তাদের জীবন ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ভাষা ছিল ফারসি। তখন ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলোর ব্যাখ্যা ফারসিতে হতো। প্রসিদ্ধ তফসিরে জালালাইনের হাসিয়া (পাদটীকা) লেখা হয়েছিল ফারসিতে। ১৮৩৫ সালে রাজভাষা পরিবর্তনের আগে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে শিক্ষিত মানুষ কর্মসংস্থান ও সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য ফারসি ভাষা আয়ত্ত করতেন এবং প্রচুর ফারসি শব্দ দৈনন্দিন জীবনে প্রবিষ্ট হয়। তখন ফারসি শব্দ ব্যবহারে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে বাধা হয়নি। লেখা বাহুল্য, ওই সব শব্দ মাতৃভাষা বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। এখন যেমন ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার শব্দ প্রতিনিয়ত বাংলা শব্দমালার মিছিলে যুক্ত হচ্ছে। ওয়াহাবি রাজশক্তি ও পাকিস্তানি কিছু দালাল, ধর্মের ছদ্মবেশে ওই সব শব্দকে বেদ্বিনি আখ্যা দিয়ে প্রকারান্তরে নতুন করে বাংলা ভাষার শত্রুতায় নিয়োজিত হয়েছে। তারা নামাজ, রোজা ইত্যাদিবহুল প্রচারিত শব্দ বাদ দিয়ে সালাত, সিয়াম প্রচলনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলার মানুষ জয় বাংলা স্লোগানের প্রতিবন্ধকতা দূর করেছে। আর দালালরা ফারসি শব্দের উচ্ছেদে নেমে ওই ভাষারই জিন্দাবাদকে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো কাঁধে নিয়ে বাংলা ভাষার শত্রুতায় নেমেছে।

ইতিহাস বলছে, ‘হাতমে বিড়ি মুহমে পান লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ বিজাতীয় ভাষার স্লোগানে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের জন্ম। ফলে প্রতিরক্ষা ও পুলিশ বিভাগ এমনকি রেলের কর্মচারীরাও উর্দুতে কথা বলত। তথাকথিত কিছু অভিজাত পরিবার উর্দুতে কথা বলে শ্রেষ্ঠত্বের ভেক ধরতেন। এখন যেমন মেকি অভিজাতরা বাইরে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক সাজেন; কিন্তু ঘরে ইংরেজিয়ানা বলয়। শোনা যায়, তাঁদের কেউ কেউ নাকি পোষা সাহেবি কুকুরের সঙ্গে ইংরেজিয়ানায় অভ্যস্ত।

আমরা আবার পঁচাত্তরের আগে ফিরে দেখি। বঙ্গবন্ধু জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘাতক ক্ষমতা দখলকারীরা যে আদেশ গ্রাহ্য না করে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার প্রায় বাধ্যতামূলক করে তোলার আয়োজন করে। সে সময়ে কিছু বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর সেখানে অবিমিশ্র ইংরেজি কায়েম করা হয়। অথচ বিশ্বের অনেক শক্তিধর জাতি তাদের মাতৃভাষাকে সম্মান দিয়েই শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে। এ হলো মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা এবং স্বাজাত্যবোধ। আমরা হতভাগা স্বভাবগতভাবে নিজ দেশের ঠাকুর ফেলে বিদেশের কুকুর সেবন করি। পরিণতি বিবেচনা না করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল খোলার ধুম ফেলে দিই। তার সঙ্গে ইংরেজি ভাষা শেখার আড়ম্বর করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হয়। এতে ব্যবসা যথেষ্ট হয়েছে। তবে ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় তেমন হয়নি। ফলে এ কূল-ও কুল দুকূল গেছে। ইংরেজি শেখেনি, বাংলা ভাষাও অবহেলিত।

বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলার আয়োজনে আড়ম্বরের অবধি নেই। এতে রবীন্দ্রনাথের কথায় আমাদের আড়ম্বরপ্রিয়তাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা কতিপয় সুযোগসন্ধানী স্তাবকের সুখে থাকার সুযোগ করে দিলেও দুঃখিনী বর্ণমালায় সৃষ্ট গ্রন্থাদি যেন দিন দিন শ্রীহীনতার পথে ধাবিত না হয়। হলে আমাদের জাতিত্ব বিলুপ্তির পথ বেছে নেবে হয়তো।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047659873962402