একজন সাঈদী কারাগারে, অসংখ্য মাঠে-ঘাটে : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - দৈনিকশিক্ষা

একজন সাঈদী কারাগারে, অসংখ্য মাঠে-ঘাটে : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে ইতিহাসের চর্চাকে সমানে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। কোনো কোনো পাঠ্যসূচিতে ইতিহাসের স্বতন্ত্র স্থানই নেই, সমাজপাঠের অংশ হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও তার নাম হয়েছে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’। বাংলাদেশের অভ্যুদয় তো কোনো ভুঁইফোড় ব্যাপার নয়, তাকে বুঝতে হলে তারও আগের ইতিহাস জানতে হবে। আর মুক্তিযুদ্ধকেও যদি যথার্থরূপে জ্ঞানের অংশ করতে চাই তাহলে তো প্রচুর গবেষণার দরকার পড়বে। উপাদান সংগৃহীত হয়েছে, আরও হবে, তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, তুলনা, প্রতিতুলনার মধ্য দিয়ে আমরা ইতিহাসের সত্যের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছাব। এর জন্য গবেষণাকে উৎসাহদান এবং অবারিতকরণ না করলেই নয়। বুধবার (৫ জুলাই) আজকের পত্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরো বলা হয়, সত্যানুসন্ধানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাটা সত্যের কণ্ঠরোধ ছাড়া অন্য কিছু নয়। স্বৈরশাসকেরা ওই কাজটা হামেশা করে থাকে, কারণ তারা ভয় করে সত্যকে। তারা তাই নানা রকমের নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর বাংলাদেশে এখন প্রত্যক্ষ-অপ্রত্যক্ষ নিষেধাজ্ঞা চালু আছে। অবস্থা অনেকটা সেই রকমেরই, পিউরিটান বিপ্লবের পরে ইংল্যান্ডে যেমনটা দেখা দিয়েছিল, মিল্টন যার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো বিপ্লবী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন না, তাঁর জগৎ ছিল প্রধানত রোমান্টিকতার। কিন্তু কাব্যের জগৎ থেকে বের হয়ে এসে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে তাঁকেও দাঁড়িয়ে যেতে হয়েছে, বিপ্লবী জন মিল্টনের মতোই। ১৮৯৮ সালে ইংরেজ সরকার সিডিশন অ্যাক্ট নামে একটি আইন জারি করার উদ্যোগ নিয়েছিল। আইন যেদিন জারি হওয়ার কথা তার আগের দিন কলকাতার এক প্রতিবাদসভায় রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন, নাম দিয়েছিলেন ‘কণ্ঠরোধ’।

দুই দশক পরে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পরে রবীন্দ্রনাথ যে অবস্থানটি নেবেন, এ ছিল তারই পূর্বাভাস। সেদিন শাসক ছিল বিদেশি। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন এই কণ্ঠরোধে ‘প্রজার’ ক্ষতি তো হবেই, ‘রাজা’ ইংরেজেরও ক্ষতি হবে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন শাসকেরা কর্ণপাত করবে না, কিন্তু তিনি পিছপা হননি। রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের সেই প্রতিবাদী ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছেন, যে ধারার সঙ্গে থেকে অনেক বড়মাপের মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। ইতিহাসে তাঁরা নন্দিত, তাঁদের বিপরীতে যাঁরা নিপীড়কের ভূমিকায় ছিলেন, তাঁরা সবাই নিক্ষিপ্ত হয়েছেন ইতিহাসরক্ষিত আস্তাকুঁড়েই। নিয়ম এটাই। আলো এবং অন্ধকারের এই দ্বন্দ্ব চলছে, চলবেই। দুইয়ে যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে তা নয়। কারণ ইতিহাস আছে, থাকবে, কাজ করবে সাক্ষীর এবং ইতিহাস কারও চাকর নয়। হিটলাররা বই পোড়াবে, কিন্তু বই লেখা তবু বন্ধ হবে না।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সংগ্রাম। ওই যুদ্ধে অন্ধকারের প্রাণীদের তো অবশ্যই, আলোর পথযাত্রীদেরও কার কী ভূমিকা ছিল, সেটা জানা দরকার। যথার্থ গবেষণা ছাড়া ওই জানাটা সম্ভবপর নয়। মুক্তিযুদ্ধ তো অনেক বড় ব্যাপার, গত কয়েক বছরের ঘটনাগুলোর ব্যাপারেই তো প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। সাংবাদিক সাগর-রুনি, কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু এবং পুলিশ সুপারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা ইত্যাদি। তদন্ত হয়েছে। তদন্ত হতে থাকবে। তদন্তকারীরা থেকে থেকে জানাচ্ছেন যে তাঁরা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন; কিন্তু দেখা যাচ্ছে সত্য কেবলই পালিয়ে বেড়াচ্ছে, সে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত। তদন্তকারীরা নিজেরাও মনে হয় সত্যের ভয়ে ভীত। ছোট ব্যাপারেই এমনটা ঘটলে, বড় বড় ব্যাপারে সত্য উন্মোচিত হবে কী করে?

বাংলাদেশে প্রায়-অবিশ্বাস্য একটি আইন পাস করা হয়েছে। এর নাম ইতিহাস বিকৃতকরণ অপরাধ আইন, ২০১৬। আইন করে ইতিহাসের বিকৃতি-নিরোধের এমন উদ্যোগ এমনকি আমাদের ইতিহাসেও দুর্লভ। যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই ঘটেছে একটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে, সেই রাষ্ট্রে আইন করে ইতিহাসের বিকৃতি রোধ করার চেষ্টা অবিশ্বাস্য বৈকি। সবচেয়ে বড় মুশকিলটা এই রকমের দাঁড়াবে যে সরকার যা বলবে, আইনের চোখে সেটাই হবে প্রকৃত ইতিহাস, এর বাইরে যা কিছু, সবই ইতিহাসের বিকৃতি। অতএব দণ্ডনীয়।

পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে পুলিশি শাসন যখন চরমে উঠেছিল, তখন শামসুর রাহমান তাঁর একটি কবিতায় লিখেছিলেন—মেয়ে, সরকারি প্রেসনোটের মতো মিথ্যা তোমার প্রেম। ওই রকমের প্রেসনোটকেই কি এখন সত্য ইতিহাস বলে মেনে নিতে হবে? অথবা সাম্প্রতিক সময়ে বন্দুকযুদ্ধ ও ক্রসফায়ারের যেসব গল্প শোনা গিয়েছে, সেগুলোকেই কি ধরে নিতে হবে প্রকৃত ঘটনা হিসেবে? ইতিহাস কিন্তু একদিন হাসবে। বলবে, সেকালে কি মানুষ ছিল না, ইতিহাসের পক্ষে দাঁড়ানোর?

সব মানুষ নিশ্চয়ই চুপ করে থাকেনি। কিন্তু তাদের কণ্ঠ চাপা পড়ে গেছে সুবিধাভোগী চাটুকারদের বড় গলার আওয়াজের নিচে। গণমাধ্যম তাদের বক্তব্যকে তুলে ধরেনি, গুরুত্ব দেওয়া পরের কথা। গণমাধ্যম সুবিধাভোগীদের দখলে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে মোবাইল ফোনের রেজিস্ট্রেশনের উপযোগিতা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। সরকার শোনেনি। এগিয়ে গেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার মোবাইল ফোন এই পদ্ধতিতেই ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নিয়ে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। নিয়ম এটাই। গরিবের কথা প্রথমে বাসি হয়, তার পরে ফলে। রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন যে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে—এ কথাও বলা হয়েছে। গরিবেরাই বলছে, সেটাও হয়তো একদিন ফলবে, তবে তখন দেরি হয়ে যাবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সম্বন্ধেও আপত্তি উঠেছিল। নানা বিপদের কথা বলা হয়েছে। কায়মনোবাক্যে আমরা কামনা করব যে এ ক্ষেত্রে গরিবের কথা যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়; কারণ সত্য বলে প্রমাণিত হলে যে বিপর্যয় ঘটবে তা কল্পনারও বাইরে।

বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বহু আগেই নির্বাসিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলে দাবি করে যে আওয়ামী লীগ, তারা কিন্তু একবারও চেষ্টা করেনি ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় নীতিকে সংবিধানে ফেরত আনতে। উপরন্তু এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনকে তারা নীরবে মেনে নিয়েছে। এমনকি বহু অপরাধসহ রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনের অপরাধেও অপরাধী, রাষ্ট্রদ্রোহী এরশাদের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে তাদের একত্রে থাকাটা নির্বিবাদে চলেছে। এরশাদ ছুটে যেতে চাইলে জেলের ভয় দেখিয়ে তাঁকে কাছে টেনে আনা হয়েছে।

আমরা জানি একাত্তরে দেশের সব মানুষ ছিল একদিকে, মুষ্টিমেয় কিছু ছিল হানাদারদের পক্ষে; কিন্তু তাদের সংখ্যা বাড়ছে। ভরসাও কিন্তু আবার তরুণেরাই। শাহবাগে যে তরুণেরা এসে জড়ো হয়েছিল, সংখ্যায় তারা বিপুল। তারাও অবস্থাপন্ন ঘরেরই সন্তান। কিন্তু তাদের আদর্শবাদটা ছিল ভিন্ন ধরনের। সেটি ছিল সমষ্টিগত মুক্তির যে স্বপ্ন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে কাজ করেছে, সেই স্বপ্নটিকে পুনরুজ্জীবিত করার।

তরুণদের সামাজিকভাবে সংকুচিত করার চেষ্টাটা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা পরিসর পাচ্ছে না। ফেসবুক সামাজিক মাধ্যম হিসেবে গণ্য হয়েছে, আসলে কিন্তু সে যা ঘটাচ্ছে তা হলো, ছায়ার সঙ্গে যোগাযোগ। ব্যক্তিকে নিয়ে আসছে ছোট বৃত্তের ভেতর, অথচ ধারণা দিচ্ছে যে মিলন ঘটছে অসংখ্য জানা-অজানা মানুষের সঙ্গে। ওই মানুষগুলো তো মানুষ নয়, তারা মানুষের চিহ্ন মাত্র। যোগাযোগ দরকার জীবন্ত মানুষের সঙ্গে। সেটা ঘটছে না। লোকে এখন সিনেমা হলে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে, তারা ছবি দেখে একাকী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পর্দায়। সবকিছুই কামরার ভেতর, তার বাইরে জগৎ নেই। খেলার মাঠ নেই। বেড়ানোর পার্ক নেই। পাঠাগার নেই, যেখান থেকে বই আনবে এবং যেখানে গিয়ে মিলিত হবে। পাড়ায়-মহল্লায় সাংস্কৃতিক কাজ নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। নাটক হয় না, এর পরিবর্তে ধর্মীয় ওয়াজ চলে, ওয়াজ শোনার জন্য লোকে চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। একজন দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী কারাগারে, অসংখ্য সাঈদী মাঠে-ঘাটে।

লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় 

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074360370635986