একাত্তরে বিজয় আসে নদী পথেও - দৈনিকশিক্ষা

একাত্তরে বিজয় আসে নদী পথেও

ফয়সাল আহমেদ |

হাজারো নদ-নদীতে ঘেরা বাংলাদেশের ভূখণ্ড।প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষ নদী তীরে বসতি গড়েছে। সখ্য নদীর সঙ্গে নদী হয়েছে তার আপনজন। তবে, এই নদীর সঙ্গে তাদের বৈরিতাও কিন্তু কম নয়। উনিশ’শ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে এই নদ-নদীই পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ত্বরান্বিত করেছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণের একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের হুঁশিয়ার করে বলেছিলেন ‘আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব’। হয়েছেও তাই।

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে অসংখ্য যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো খোদ নদীতেই। নদীতে সংঘটিত ছোট-বড় যুদ্ধে বীর বাঙালির কাছে পরাস্ত হয়েছে পাক-হানাদার বাহিনী। এসব নদী দিয়েই ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো লাখ লাখ বাঙালি। সে সময় সীমান্তের এক-একটা নদী হয়ে উঠেছিলো আশ্রয়প্রার্থী অসহায় মানুষগুলোর বিশ্বস্ত বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির অন্যতম প্রিয় স্লোগান ছিলো- ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা, মেঘনা, যমুনা।’ শুধু পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নয় বাংলার প্রায় সব নদ-নদীই হয়ে উঠেছিলো মুক্তিকামী বাঙালির ঠিকানা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই সমর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলো। এর প্রধান কারণ বাংলার এই অঞ্চলটিই নদ-নদী প্রধান। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার লেখায়। একইভাবে পাকিস্তানি লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ১৯৭১ এর যুদ্ধে বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য পর্যক্ষেণ করে সেনা মোতায়েন করেছিলেন। এবং তাতে নদীই ছিলো গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হাজারো গণহত্যা সংগঠিত করে বাংলার নদ-নদীর তীরেই। তারা বাঙালিদের হত্যা করে লাশ ফেলে দিতো নদীতে। অসহায়, নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অব্যাহত নির্মম নির্যাতনে রক্তস্নাত বাংলার হাজারো নদী ফুঁসে ওঠে হানাদারদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নদী হয়ে ওঠে সহায়ক শক্তি। নদ-নদী বিধৌত বাংলায় বেড়ে ওঠা দামাল ছেলেদের কাছে সবকিছুই ছিলো পরিচিত। হাতে অস্ত্র নিয়ে নদীতে সাঁতার কাটতে কাটতে কখনো বা পানিতে ডুবাতে ডুবাতে যুদ্ধ করেছে তাঁরা। পক্ষান্তরে পাকিস্তানিদের কাছে তা একেবারেই অপরিচিত পরিবেশ। এই সুযোগটাই কাজে লাগায় রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা। নদী পথের লড়াইকে আনো জোড়ালো করার লক্ষে প্রতিষ্ঠা করা হয় নৌ-কমান্ডো দল। সারা দেশের নদীপথে গেরিলা অপারেশন চালানোর জন্য এই দল তৈরি করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন নৌ-কমান্ডো, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ও অভ্যন্তরীণ নৌপথ দশ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিলো। এই সেক্টরে পদস্থ কর্মকর্তা না থাকায় ছিলো না কোনো অধিনায়ক। 

নৌকমান্ডো বাহিনী চট্টগ্রাম, চালনা-খুলনা, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি-চাঁদপুর নিয়ে চারটি টাস্কফোর্সে বিভক্ত ছিলো। প্রতিটি টাস্ক ইউনিটে ১০টি করে টাস্ক এলিমেন্ট ছিলো। প্রতিটি টাস্ক এলিমেন্টে ছিলো তিনজন করে নৌযোদ্ধা। প্রত্যেক নৌযোদ্ধার জন্য বরাদ্দ ছিলো দুটো করে লিমপেট মাইন, একটি গ্রেনেড, একটি ছোড়া, একটি কম্পাস ও একজোড়া ফিন্স (সাঁতারের সময় পায়ে বাঁধা ডানা)। এর বাইরে প্রতিটি টাস্ক এলিমেন্টের জন্য ছিলো একটি রাইফেল। 

ফয়সাল আহমেদ 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ভাগীরথী নদীর তীরে। নদীটি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রবাহিত। ভাগীরথী নদীর তীরে যে মাঠটিতে নৌ-কমান্ডোদের প্রশিক্ষণ হয়েছিলো সেটিই ঐতিহাসিক পলাশীর প্রান্তর। যে মাঠে ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন বাংলা-বিহার-উরিষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে। নদীতীর সংলগ্ন মাঠে নৌ-কমান্ডোদের জন্য তৈরি করা হয় সারিবদ্ধভাবে অসংখ্য তাঁবু। ভারতীয় নৌবাহিনীর তিনজন অফিসারের সমন্বয়ে গঠিত একটি রিক্রুটিং টিম বিভিন্ন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ঘুরে প্রাথমিকভাবে নৌ-কমান্ডো প্রশিক্ষণের জন্য ৩১৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সিলেক্ট করেন। 

১১ জুন ১৯৭১। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাগীরথী নদীর তীরে স্থাপিত ক্যাম্প পরিদর্শনে যান, সঙ্গে কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী। এ ছাড়াও প্রশিক্ষণ চলাকালীন মুজিবনগর সরকারের উপ ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ভারতীয় নৌ বাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল এস এস নন্দা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন, প্রশিক্ষণার্থী যোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলেন।

পলাশীর এই নৌ-ক্যাম্পটি নিয়ন্ত্রণ করতো ভারতীয় নৌ-বাহিনী। ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জি এম মার্টিস। এই ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ অফিসার ছিলেন ভারতীয় নৌ-বাহিনীর অফিসার লেফটেন্যান্ট এ কে দাস ও লেফটেন্যান্ট কপিল। এই ক্যম্পেই যোগ দেন সে সময় ফ্রান্স থেকে মাতৃভূমির টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে আসা আটজন বাংলাদেশি সাবমেরিনার। নৌ-কমান্ডোদের এই প্রশিক্ষণ পরে যাঁরা যোগ দেন, তাদের অধিকাংশই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলের ছাত্র এবং চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনার তরুণ-যুবক। 

অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী এই যুবকেরা পূর্ব বাংলার খরস্রোতা নদীগুলো থেকে যথাসম্ভব সুবিধা নেয়ার মতো সাঁতারের কৌশল জানতেন। সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাদের মাইলে পর মাইল সাঁতরাতে হতো, বা বাঁশ বা পেঁপে পাতার চোঙা দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ে পানিতে মাইন বহন করে শত্রুপক্ষের কাছাকাছি রেখে সেটি বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই সাঁতরে নিরাপদ দূরত্বে ফিরে আসতে হতো।  এ ধরনের কঠিন কাজের জন্য যে দৈহিক ও মানসিক শক্তিমত্তার প্রয়োজন, পূর্ব বাংলার তরুণদের তা প্রচুর পরিমাণে ছিলো। তাই সাঁতারু বা ফ্রগমেন বাহিনীর নেতৃত্ব শুরুর দিকে নৌ-বাহিনীর সদস্যদের হাতে থাকলেও অচিরেই তা চলে যায় বিপুলভাবে উদ্দীপিত শিক্ষিত যুবকদের হাতে। 

এখানকারই একটি ৩১ সদস্যের নৌ-কমান্ডো টিম ১৪ আগস্ট রাতে অপারেশন চালায় কর্ণফুলী নদীর চট্টগ্রাম বন্দরে। সেদিন শুধু চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতেই নয় একযোগে চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ বন্দর আক্রমণ করে পাকিস্তান বাহিনীর ২৬টি পণ্য ও সমরাস্ত্রবাহী জাহাজ ও গানবোট ডুবিয়ে দেয়। এতে দুর্বল হয়ে পরে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌশক্তি। অপারেশন ‘জ্যাকপট’ খ্যাত দুঃসাহসিক সেই অভিজানে হানাদারদের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো বাংলার দামাল ছেলেরা। পরে সেই অপারেশনের কথা ফলাওভাবে প্রচার হয় আন্তর্জতিক সংবাদমাধ্যমে। বিশ্বাসী জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা। শুধু পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর তীরের স্থাপিত নৌ-কমান্ডো ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসা যোদ্ধারাই নয়, লক্ষ লক্ষ সাধারণ প্রশিক্ষণপ্রান্ত মুক্তিবাহিনী তাদের নিজস্ব কৌশল ব্যবহার করে নদীতে সংগঠিত যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। 

নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে, বিশেষ করে বর্ষাকালে, নদী ব্যবহারের সুবিধা ভোগ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ সময় নদীগুলোও তাদের সহযোদ্ধা হয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে একসাথে লড়াই করে। আগস্ট মাসে দেশের নদী বন্দরগুলোতে নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত অপরারেশন ‘জ্যাকপট’, সেপ্টেম্বরে পাকিস্তানিদের রসদবাহী জাহাজে হামলা এবং ডিসেম্বরে অপারেশন ‘হটপ্যান্টস’ তাদের নৌশক্তি বিধ্বস্ত করে দেয়। যার ফলস্রুতিতে একাত্তরে বাংলাদেশের বিজয় আসে নদী পথেও। ইতিহাসের বিচারে একাত্তরে নদীই হয়ে ওঠে অন্যতম মুক্তিযোদ্ধা। কবি ওবায়দুল ইসলাম তার ‘একাত্তুরের নদী’ কবিতায় তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধে নদীর ভূমিকা। তিনি লিখেছেন: 
‘বাঙালির দামাল ছেলের মতো
নদীও যুদ্ধে ছিল একাত্তুরে।
প্রমত্ত পদ্মায়, যমুনায়-মেঘনায় 
ধলেশ্বরী, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁর বাঁকে বাঁকে 
কর্ণফুলী, করতোয়া, কুমার-কাবেরী 
কুশিয়ারা-সুরমা কূলে-উপকূলে 
ভয়ঙ্কর যুদ্ধ এবং সশস্ত্র-বিদ্রোহ।
নদীও যুদ্ধ জানে। যুদ্ধে জন্ম যার রণক্ষেত্র ঘুরে
সে জানে মৃত্যু কোথায় সেই একাত্তুরে 
বিকেলে হলুদ নদী যে রক্তাক্ত হতো রাতে 
সারারাত লাশ বয়ে নিয়ে বীরবেশে দাঁড়াতো প্রভাতে।’

লেখক: গবেষক ও সম্পাদক  

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0077009201049805