বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন সত্তা - দৈনিকশিক্ষা

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক অভিন্ন সত্তা

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন |

‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘বাংলাদেশ’-দুটি নাম একটি ইতিহাস; এক এবং অভিন্ন, যেনো একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান একটি চেতনা, একটি নাম, একটি সংস্কৃতি, একটি অধ্যায়, একটি দেশ। যার জন্ম না হলে হয়তো আমরা বাংলাদেশ নামক স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রটি পেতাম না। পরাধীনতার শেকল থেকে এ দেশকে, এ জাতিকে মুক্ত করতে যিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন, তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের কথা বললেই বঙ্গবন্ধুর নাম বলতে হয়। বঙ্গবন্ধু দেশের ও জনগণের স্বার্থের জন্য নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছিলেন। কবি-অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলাদেশের আরেক নাম রেখেছেন ‘মুজিব ল্যান্ড’।

বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার মহা-নায়ক। আর এ কারণেই তাকে বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিশোর বয়স থেকেই শেখ মুজিব প্রতিবাদী ছিলেন, সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলতেন। ভীতি ও অত্যাচারের মধ্যেও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। বাগেরহাটে একটি নির্বাচনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘শুধু প্রধানমন্ত্রী কেনো, সারা দুনিয়ার ঐশ্বর্য আর ক্ষমতা আমার পায়ের কাছে ঢেলে দিলেও আমি দেশের, বিশেষ করে বাংলার বঞ্চিত মানুষের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না’। শোষিত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে বলেছিলেন-‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষে শোষক, আরেক পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধু মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে ছিলেন সোচ্চার। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা-আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা দাবি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিঁনি ছিলেন নেতৃত্বের ভূমিকায়। গণতান্ত্রিক অধিকারের পক্ষে তিনি ছিলেন সর্বদা বজ্র কণ্ঠ। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নাম চিরদিনই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করার ফলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী হয়ে পড়ি। তখন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে। পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি থাকলেও আমাদের কোনো স্বাধীনতা ছিলো না। আমাদের মায়ের ভাষা বাঙলা এর পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রভাষা উর্দুকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হতো। এই শোষণ থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতেই জন্ম হয় শেখ মুজিবর রহমানের। তিনি ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে শুরু করে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিটি ধাপে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে গোপালগঞ্জ মিশনারি হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে। বঙ্গবন্ধু কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে আই.এ এবং ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাশ করেন এবং ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন। ছাত্রাবস্থায় বিশ্বদ্যিালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ছাত্রত্ব হারিয়েছিলেন, তাকে তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  বহিষ্কার করা হয়। যদিও ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে সেই বহিষ্কার আদেশ তুলে নেয়া হয়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশভাগের সময় শেখ মুজিব ছিলেন একজন তরুণ ছাত্র নেতা তাই তিনি ওই সময়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রচণ্ড সাংগঠনিক ক্ষমতা, অমিত সাহস, অসীম ভালোবাসা, এসব মিলেয়ে যে মানুষটি তৈরী হয়েছিলেন, তিনি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ভারত পাকিস্তান বিভাজনের পরে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে অধ্যায়নকালে তিনি গঠন করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ। এটি প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ৪ জানুয়ারি, এর মাধ্যমেই তিনি একজন অসমান্য ছাত্র নেতায় পরিনত হন। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেন এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন

১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সেসময় কারাগারে বন্দি ২৯ বছর বয়সী শেখ মুজিবকে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর আগেই বঙ্গবন্ধু নিজ উদ্যোগে পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজকে নিয়ে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দেই তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তাকে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে কোয়ালিশন সরকারের শিল্প, বাণিজ্য এবং দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে এক বছর সফলতার সঙ্গে জনগণের জন্য কাজ করেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সাংগঠনিক স্বার্থে মন্ত্রিত্বের মতো লোভনীয় পদ ত্যাগ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে শেখ মুজিব উদ্যোগী হয়ে সমমনা ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামের গোপন সংগঠন। 

১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের পরিপূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা বর্ণিত ছিলো। এ সময় ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়তে পূর্ববাংলা সফরের সময় মাত্র দুই মাসে আটবার গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ১ মার্চ শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে পাকিস্তান সরকার মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে এনে তার বিচার শুরু হয় এবং পরবর্তীতে তিনি  নির্দোষ প্রমাণিত হন। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি ৬ দফাসহ ১১ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। 

ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ত্যাগ ও অবদানকে সম্মান জানিয়ে ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় প্রায় ১০ লাখ ছাত্র-জনতার সংবর্ধনা সমাবেশে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৯ এর ৫ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববাংলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে’ বাংলাদেশ’ নামকরণ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সবস্তরের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যদের অধিবেশন চলাকাকালে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনিদিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সারা বাংলা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিক্ষুদ্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয় রাজপথ। এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে মানুষের ঢল নামে। সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর এবং পূর্ব বাংলাকে নেতৃত্বশূন্য করতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা হামলা শুরুর সঙ্গেই অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে রাত সাড়ে ১২টার সময় ওয়্যারলেস যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে চট্রগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন। সারা বিশ্বে খবর ছড়িয়ে যায়, বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হতে চলেছে!

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সামরিক আদালত বিচারের রায় ঘোষণা করে, মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। যে সেলে তিনি ছিলেন, তার পাশে কবরও খোঁড়া হয়, তবে যুদ্ধ পরিস্থিতির সঙ্গে এ সিদ্ধান্তেরও পরিবর্তন হয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি যোদ্ধারা শুধু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেনি বরং তাদের প্রাণের নেতা, যার নেতৃত্বে বাঙালির সংগ্রামের শুরু, যার নির্দেশে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়া, তাকে স্বাধীন দেশে ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থাও করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। যুদ্ধ শেষে এ দাবি আরো জোরালো হয়। অবশেষে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ত্যাগ করেন। তিনি ইংল্যান্ড ও ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন। তার এই প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়। 

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন জাতির পিতা। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি’র বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সন্দেহাতীতভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগ ছিলো তার দেশ ও দেশের মানুষের উন্নয়ন ঘটানো। বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন যার লক্ষ্য ছিলো-দুর্নীতি দমন, ক্ষেত-খামার ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, শোষণহীন সমাজ গঠন ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। বাঙালি জাতিকে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা উপহার দেয়ার জন্যে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পরপরই একটি আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের জন্যে তিনি যে সকল উদ্যোগ গ্রহণ করেন তার অন্যতম হলো যথাক্রমে সংবিধান প্রণয়ন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমে গতি সঞ্চার, মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্রসমর্পনের নির্দেশ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পুনর্গঠন, প্রথম সাধারণ নির্বাচন আয়োজন, প্রত্যেকটি মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর, শিক্ষা কমিশন গঠন, পরিকল্পনা কমিশন গঠন, ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, ব্যাংক জাতীয়করণ, মুদ্রা ও টাকা চালুকরণ, কৃষি সংস্কার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উন্নতি সাধন ইত্যাদি। শিক্ষার প্রসারে প্রাথমিক শিক্ষায় ১ লাখ ৬৫ হাজার নিয়োগ দেন। 

এ লক্ষ্যে জাতির অগ্রগতি নিশ্চিত করার মানসে বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন ‘বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’। সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অর্থনৈতিক মুক্তির এই সংগ্রামে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে তিনি অভূতপূর্ব সাড়া পান। অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়, দুর্নীতি-চোরাকারবারি বন্ধ হয়। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সংকটাবস্থা কাটিয়ে উঠতে শুরু করে, স্বাধীনতার সুফল পৌঁছতে শুরু করে গণমানুষের দোরগোড়ায়। তার এই দেশপ্রেম নীতির কারণে তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্ষূশূলে পরিণত হন। বঙ্গবন্ধু যখন একটি আধুনিক, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিলেন, ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি মহলের সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে।  বঙ্গবন্ধুকে হত্যা নিছক কোনো সাধারণ ঘটনা ছিলো না। সেদিন বাঙালি জাতির পিতাকে হত্যা করে কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলই খুনিদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। সেদিন তারা হত্যা করতে চেয়েছে বাংলাদেশ, বাঙালিত্ব ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে। 

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ২৯৩ আসন লাভ করে। অবিসংবাদিত এই নেতাকে ধারণ করার অর্থই হলো বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের মূল অস্তিত্বকে ধারণ করা। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মেও ভেদাভেদ করেননি। তিনি সব সময় বলতেন ‘আমি মানুষকে কেবল মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান বলে কিছু নেই। সবাই মানুষ।’

একটা বিজয়ী স্লোগান, একটা স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন জাতীয় সংগীত অর্থাৎ স্বাধীন বাঙালি জাতিসত্তা এমনভাবে ইতোপূর্বে কেউ প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। তিনি অনেক শত্রুকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, বিচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক ধারায়। বঙ্গবন্ধু দেশে এমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যাতে সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করতে পারে, অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটে। 

বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ একই সূত্রে গাথাঁ। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এদেশে মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত হতো না। তেমনি মুক্তিযুদ্ধ না হলে এদেশে স্বাধীনতার সূত্রপাত হতো না এবং সৃষ্টি হতো না স্বাধীন বাংলাদেশের। তিনি যে দারিদ্র, ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। পরিশেষে বলি, ‘ভেঙেছে দুয়ার এসেছে জোর্তিময় মুজিব তোমার জয় হোক’। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন নাম।  

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয় 

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি - dainik shiksha রোববার থেকে সরকারি প্রাথমিকে মর্নিং স্কুল, খোলার প্রজ্ঞাপন জারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী - dainik shiksha গরমে কলেজে কোচিং, দুদিনে অসুস্থ ৮ ছাত্রী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha নিবন্ধিত শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসির নতুন নির্দেশনা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট - dainik shiksha জাল সনদে চাকরি করছে কয়েক হাজার হেলথ টেকনোলজিস্ট ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ফের আন্দোলনের হুশিয়ারি চুয়েট শিক্ষার্থীদের আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ - dainik shiksha আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন শিক্ষক নেতা কাওছার শেখ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043799877166748